৬ মাস চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের। শেষ কোথায় এই যুদ্ধের? আরো কত মাশুল গুনতে হবে বিশ্বকে? এমন অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন সামনে রেখে ছয় মাস পূর্ণ হলো রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের। ধারণা করা হচ্ছিল, পরাক্রমশালী রাশিয়ার ‘সামরিক অভিযানে’ ক্ষুদ্র শক্তির ইউক্রেন দাঁড়াতেই পারবে না। অসম এই যুদ্ধ পলকেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি।
যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই; আন্তর্জাতিক উদ্যোগও দৃশ্যমান নয়। বরং দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কথাই বলছেন সমরবিদরা। ইউক্রেনের পাশে সক্রিয়ভাবে মার্কিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমর্থন থাকায় এটাকে আজীবনের যুদ্ধ বলেই মনে করছেন তারা। যদি না ইউক্রেনের ভূমি (দনবাসের একাংশ) দখল করাকে ‘বিজয়’ আখ্যায়িত করে নিজেরাই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা না দেয়। যুদ্ধ শেষ হোক বা না হোক- এর প্রভাবে ইউক্রেন থেকে অনেক দূরের দেশেও- দোকানে রান্নার তেল শেষ হয়ে যাচ্ছে, লোকেরা গ্যাস পাম্পে বেশি দাম দিচ্ছে, কৃষকরা সার কেনার জন্য ঝাঁকুনি নিচ্ছে এবং দেশগুলো জোটের পুনর্বিবেচনা করছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ ভূমিকম্পের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে; একটি দ্রুত চলমান শরণার্থী সংকট, একটি প্রধান অর্থনীতির বিরুদ্ধে নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা এবং একটি পুনরুজ্জীবিত ন্যাটোসহ বৈশ্বিক সম্পর্কের পরিবর্তন এনেছে।
মুদ্রাস্ফীতি দেশে দেশে : খাদ্য, জ¦ালানি এবং আন্তর্জাতিক শান্তি বিনষ্ট হওয়ার কারণে দেশে দেশে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে। মুদ্রা বিনিময়ে দ্ব›দ্ব তৈরি হয়েছে। অনেক উন্নত দেশেই মুদ্রাস্ফীতি বর্তমানে ৪০ বছরের সর্ব্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। হিমশিম খাচ্ছে উন্নয়নশীল ও গরিব দেশগুলো।
জ¦ালানি সংকটে বিপর্যস্ত বিশ্ব : ইউরোপসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশে জ¦ালানি তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। রাশিয়া ইউরোপের প্রায় সব দেশেই জ¦ালানি সরবরাহ বন্ধ করায় ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যর দেশগুলোয় জ¦ালানির দাম বেড়েছে। এর সঙ্গে বেড়েছে পরিবহন খরচও। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পণ্যের দাম। জ¦ালানির কারণে সার উৎপাদন প্রায় বন্ধ। রাশিয়া সার ও পেট্রোলিয়ামের একটি প্রধান উৎপাদক দেশ। এই
পণ্যগুলোর সরবরাহে বিশৃৃঙ্খলা এবং জলবায়ু চ্যালেঞ্জগুলোকে আরো জটিল করে তুলছে। খাদ্য ও গ্যাসের দাম বেড়ে গেছে, ঘাটতি দেখা দিয়েছে এবং লাখ লাখ মানুষকে ক্ষুধার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।
খাদ্যের জন্য আহাজারি আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে : যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনে গম ও ভুট্টার মতো খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রপ্তানি বন্ধ থাকায় জাতিসংঘ ও তুরস্কের প্রচেষ্টায় খাদ্যশস্য পরিবহন পুনরায় চালু করা হয়েছে। তবে তা এখনো পর্যাপ্ত নয়। ইউক্রেন ও রাশিয়া গম, বার্লি, ভুট্টা ও রান্নার তেলের প্রধান রপ্তানিকারক, বিশেষ করে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর জন্য। গবেষকরা বলছেন, পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ তো পরের কথা, তুলনামূলক ছোট আকারের পারমাণবিক সংঘাতও বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে।
পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কায় আগামী প্রজন্ম : এই যুদ্ধ দিয়েই শুরু হয়ে যেতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। শুরু থেকেই ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয়রা। সরাসরি যুদ্ধে না জড়ালেও ইউক্রেনকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করছে পশ্চিমারা। গবেষণায় উঠে এসেছে, অত্যাধুনিক পারমাণবিক যুদ্ধ এবং এর কারণে যে প্রভাব দেখা দেবে, তাতে বৈশ্বিক দুর্ভিক্ষে প্রায় ৫০০ কোটি মানুষের মৃত্যু হতে পারে। এতে বলা হয়েছে, পারমাণবিক যুদ্ধের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় যত জন মারা যেতে পারে, ওই যুদ্ধের কারণে হওয়া বৈশ্বিক দুর্ভিক্ষে সম্ভবত তার চেয়ে অনেক বেশি লোক মারা যাবে।
রুটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা সম্ভাব্য ছয়টি পারমাণবিক সংঘাতের ক্ষেত্রে কী কী প্রভাব পড়তে পারে তার একটি পর্যালোচনা করেন। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রর মধ্যে পুরোদস্তুর পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হলে- এতে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে যুদ্ধ কতদিন চলবে, তা জানেন কেবল রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। তিনি আগেই বলেছেন, লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত থামবে না রাশিয়া।
মুখোমুখি রাশিয়া-আমেরিকা : স্নায়ুযুদ্ধের যুগে প্রবেশ করেছে বিশ্ব। আবার বিভক্ত বিশ্ব দেখছে মানুষ। আর এটি নতুন করে উত্তেজনা এবং এক ধরনের যুদ্ধাবস্থা তৈরি করছে। ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি অবস্থান। চীন-রাশিয়ার সম্পর্কের উষ্ণতা পুরো বিশ্বকে যেন আবার বিভক্ত করছে। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য একদিকে। অন্যদিকে রাশিয়া-চীনের মতো দুই প্রভাবশালী ক্ষমতাধর রাষ্ট্র। এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে বিশ্ব। একদিকে চীনের অর্থনৈতিক আগ্রাসন, অন্যদিকে রাশিয়ার সামরিক শক্তি। দুই মিলিয়ে আবার যেন শীতল যুদ্ধের সময় শুরু হয়ে গেল।