বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন এবং বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপযোগী জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে বেশ কিছু কার্যক্রম শুরু করেছে । দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আন্তর্জাতিক মানদন্ডের আওতায় আনার উদ্দেশ্যেই এ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
এই পদক্ষেপের অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির জন্য একটি নির্দিষ্ট যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেয়া হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বক্ষেত্রে বিশেষ করে (একাডেমিক ও আর্থিক) খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া উচ্চশিক্ষার জন্য লিয়েনে থাকা শিক্ষকরা সময়মতো না ফিরলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে ইউজিসি।
ইউজিসি চেয়ারম্যান হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনকারী কমিশনের সদস্য (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক ডক্টর দিল আফরোজা বেগম বলেন, বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপযোগী জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক মানদন্ডের আওতায় আনার উদ্দেশ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডক্টর মাকসুদ কামাল গত শুক্রবার শিক্ষা সাংবাদিকদের এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘২০২৩ সাল থেকে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতিতে নির্দিষ্ট যোগ্যতা ও মান অর্জন ছাড়া নিয়োগ-পদোন্নতি পাবেন না। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে এখন থেকে কোনো ছাড় নয়। যোগ্যদেরই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হবে।’
ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, উচ্চশিক্ষার জন্য ছুটি নিয়ে বিদেশে গিয়ে না ফেরা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একধরনের রোগে পরিণত হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে এ রোগ। এ ব্যাপারে অতীতে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুলসংখ্যক শিক্ষক ছুটি নিয়ে বিদেশে গিয়ে আর দেশে ফেরেননি। ইউজিসির এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এ সংখ্যা কয়েক শতাধিক। এবার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষকদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছে ইউজিসি।
এদিকে, উচ্চশিক্ষার জন্য ছুটি নিয়ে বিদেশে অবস্থান সংক্রান্ত বিধানটি হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক উচ্চশিক্ষার জন্য সর্বোচ্চ চার বছর পর্যন্ত ছুটি নিতে পারেন। পরে আরও দুই বছরের অবৈতনিক ছুটির আবেদন করতে পারেন। তবে, সে ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য কারণ প্রদর্শন ও তার প্রমাণ স্বরূপ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠাতে বা জমা দিতে হয়। কিন্তু বিগত বেশ কিছু বছর ধরে ছুটি নেওয়া শিক্ষকরা বিধানটি অনুসরণ করছেন না বলে ইউজিসির অভিযোগ।
তাদের অভিযোগ, লিয়েনে যাওয়া শিক্ষকরা ছুটি বাড়ানোর জন্য আবেদন পাঠিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন। কারণ লিয়েনে ছুটি নেয়া শিক্ষকরা তাদের সম্মানী পেয়ে থাকেন। তাই তারা সম্মানী বহাল রাখতে তৎপর থাকেন।
২৯ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ইউজিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৩ জন শিক্ষককে চাকরিচু্যত করা হয়েছে। এ অভিযোগে ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১৪ শিক্ষককে এক বছরে চাকরিচু্যত করা হয়েছে। আরও ১৩০ শিক্ষকের বিরুদ্ধে একই ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এর মধ্যে বড় অংশই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট)। প্রতিবেদনের বাইরে আরও অন্তত ১৭ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩১ জন শিক্ষক চাকরিচ্যুত হয়েছেন। আরও ১৮ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
এক বছরে বেশি চাকরিচ্যুত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ জন শিক্ষক। এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ জন ও বুয়েটের ২১ জন শিক্ষক চাকরিচ্যুত হয়েছেন। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ জন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ জন, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ জন, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন, জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ জন এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক চাকরিচ্যুত হয়েছেন।
যে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রক্রিয়াধীন সেই তালিকায় শীর্ষে আছে বুয়েট। ৪১ জন শিক্ষক ছুটি শেষে কর্মস্থলে ফেরেননি। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষকও ফেরেননি। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ জন করে শিক্ষকের ছুটি শেষ হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ জন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাড়াও ১৫ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮ জন শিক্ষকের ছুটি শেষ হয়েছে তবে তারা দেশে ফেরেননি। তাদের ব্যাপারে ইউজিসির পর্যবেক্ষণ রয়েছে।
ইউজিসির সদস্য ডক্টর মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, ছুটি শেষে শিক্ষকদের দেশে না ফেরায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন শিক্ষার্থীরা। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ পরিকল্পনায় ব্যাঘাত ঘটে। শিক্ষক-সংকট দেখা দিচ্ছে। এর একটি সুরাহা হওয়া উচিত।
এদিকে, ঢাকায় একটি দূতাবাসে বিনা অনুমতিতে পূর্ণকালীন চাকরি করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক আশরাফ-উজ-জামান সরকারকে বরখাস্ত করা হয়েছে। গত ৩০ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষকের একই সময়ে দুই কর্মস্থলে পূর্ণকালীন চাকরি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং চাকরির বিধিবিধান, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা পরিপন্থি। ট্রাইবু্যনালের সুপারিশের প্রেক্ষিতে তাকে বরখাস্ত করা হয়।