রাজশাহীর সুখ-দুঃখ
সপ্তদশ শতকে ডাচ ব্যবসায়ীরা রামপুর-বোয়ালিয়া গ্রাম দুটি নিয়ে রাজশাহী শহরের গোড়াপত্তন করেন। নদীপথে রাজশাহীর সঙ্গে বাণিজ্যনগরী কলকাতার দূরত্ব কম। ফলে বাণিজ্যনগরী হিসেবে রাজশাহীর শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। বহু মত ও পথের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রাজশাহীর গুরুত্ব বিশ্বখ্যাত, বিশেষত সিল্ক ও নীলের ব্যবসার জন্য।
এখনো পদ্মাপারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ডাচ কুঠি তার বড় প্রমাণ। দখলদারদের সর্বগ্রাসী দৌরাত্ম্যে নীলকুঠির স্মৃতিচিহ্ন অবশিষ্ট নেই রাজশাহীতে। জৈন ধর্মাবলম্বীদের শেষ চিহ্ন শেষ হওয়ার পথে। ঐতিহাসিক শহর রাজশাহীর ইতিহাস সংরক্ষণের কোনো মহতী উদ্যোগ সর্বসাধারণের দৃষ্টিগোচর নয়। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে।
ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে হজরত শাহ মখদুম (রহ.) রাজশাহীতে আগমনের পর পদ্মাপারে মুসলিম মহল্লা দৃশ্যমান হয়। নাটোর থেকে ১৮২৫ সালে জেলার সদর দপ্তর রাজশাহীতে স্থানান্তরের পর রামপুর-বোয়ালিয়া গুরুত্ব হারিয়ে শহর হিসেবে রাজশাহীর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। ইতিহাসের পাতায় স্থান নেয় রামপুর-বোয়ালিয়া। সিল্ক ও নীলের ব্যবসায় ধস নামার সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহীর গুরুত্ব হ্রাস পায়। বিশেষ করে নদীপথে কলকাতার সঙ্গে রাজশাহীর যোগাযোগ গুরুত্বহীন হয়ে যাওয়ার পর রাজশাহী সুশ্রী থাকে না। রাজশাহীর সঙ্গে প্রতিবেশী দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
মেট্রোপলিটন দৃষ্টিনন্দন গ্রিন সিটি রাজশাহী নতুন রূপে নতুন আকার-আয়তনে বসবাসের উপযুক্ত শহর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। একসময়ের দুঃখ হিসেবে পরিচিত ভাঙনকবলিত পদ্মা এখন পথচারীর পদচারণে মুখরিত। সিল্কের শহর পর্যটননগরী হিসেবে হয়তো একসময় আত্মপ্রকাশ করবে, যার সব ব্যবস্থা ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। প্রথমত রাজশাহী পরিচ্ছন্ন শহর। প্রতিদিন সন্ধ্যায় শহর পরিষ্কার করা হয়। রাস্তা প্রশস্ত, যানজটমুক্ত। নির্ধারিত গন্তব্যে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছতে কোনো অসুবিধা হয় না। বাড়িভাড়া তুলনামূলক কম। অল্প খরচে ভালো থাকা যায়। শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে মাত্র কুড়ি টাকায় অটোরিকশায় যাওয়া যায়। টাটকা শাক-সবজি, মাছ, মাংস ও ফল পাওয়া যায়। আমকেন্দ্রিক উৎসব রাজশাহীকে মহিমান্বিত করে। মধ্যবিত্তের আরামদায়ক শহর হিসেবে রাজশাহী অতুলীয়।
এ সুখের কোনো সীমা নেই, কিন্তু ‘হাসির পরে কান্না আছে, দুঃখের পরে সুখ। আঁধার রাতের শেষে যেমন দেখিস আলোর মুখ। ’ রাজশাহী এর ব্যতিক্রম নয়। সুযোগ-সুবিধার আলোর নিচে উদগ্রভাবে প্রকাশ পায় চাপা কান্না। শহরের শ্রমজীবী মানুষের আয়ের প্রধান একটি উৎস তিন চাকার অটোরিকশা। সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি একজন রিকশা শ্রমিক আয় করেন হাজার টাকার ওপর। রিকশার চার্জের জন্য বিদ্যুৎ বিল এবং অন্যান্য খরচ বাবদ লাগে দেড় থেকে দুই শ টাকা। বাকি টাকায় চলে সংসার। এই হিসাব জমা রিকশার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। চার শ টাকা জমা দিয়ে পরে যা থাকে চালকের। বেশির ভাগ রিকশাচালক রিকশা কিনতে চান। কিন্তু নগরীতে একটি রিকশার লাইসেন্স সংগ্রহ করতে লাগে ৫০-৬০ হাজার টাকা। তাও আবার পুরনো লাইসেন্স। ফলে শ্রমজীবী মানুষ ধারদেনা করে রিকশা কিনলেও পাচ্ছেন না লাইসেন্স। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এ রকম একজন রিকশাচালক জানালেন, তিনি শহরে যান না। তাঁর রিকশার লাইসেন্স নেই। রাব্বেল হোসেন রিকশার লাইসেন্স নিয়েছেন পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে। রিকশা গ্যারেজের মালিকের কাছ থেকে প্রথম লাইসেন্স নিয়ে প্রতারিত হয়েছিলেন। যার রিকশা সে চালালে নগরে চরম দরিদ্র মানুষের জীবন কিছুটা হলেও সহনীয় হবে। রিকশার লাইসেন্স নামমাত্র মূল্যে প্রদান করা কোনো জটিল কাজ নয়। কর্তৃপক্ষ সদয় হলে হতদরিদ্র মানুষের জীবন কিছুটা হলেও সহজ হবে।
রাজশাহী শহরের আশপাশের এলাকা যেমন বানেশ্বর, পুঠিয়া, গোদাগাড়ী, তানোর থেকে অনেক শ্রমজীবী মানুষ শহরে আসেন কাজের সন্ধানে। নগর পরিবহন সহজীকরণ না হওয়ায় প্রতিদিন এসব নিম্ন আয়ের মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার কোনো সমাধান নেই। মধ্যবিত্তের আহার-বাসস্থানের টানাপড়েনের পর বিশুদ্ধ বিনোদনের স্বল্পতা শহরে দৃশ্যমান। কোথাও বসে একটু চা-কফি খাবেন, একটু শীতল বাতাসে বসে বই পড়বেন—এমন কোনো স্থান নেই। বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেবেন তার স্থানও সংকুচিত। শহরে কোনো উন্নতমানের বইয়ের দোকান গড়ে ওঠেনি, যেখান থেকে দেশি-বিদেশি প্রয়োজনীয় সব রকম বই সংগ্রহ করা যায়। বই অন্য পণ্যের মতো একটি সাধারণ পণ্য নয়। বইয়ের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক নিবিড়। আত্মার সম্পর্ক হয় আত্মীয়তা দিয়ে। শিক্ষানগরী রাজশাহীতে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপনের কোনো পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে বলে মনে হয় না। সৃজনশীল বইয়ের দোকান হিসেবে সিটি সেন্টারে বিদ্যাসাগর কোনো রকম ঢিমেতালে জ্বলছে। জ্বালানির স্বল্পতা দৃশ্যমান।
গ্রিন সিটি রাজশাহীতে উন্নতমানের ড্রেনেজ সিস্টেম গড়ে না উঠলেও জলাবদ্ধতা নেই। ওয়াসার বিশুদ্ধ পানির সমস্যা থাকছেই। ফলে টিউবওয়েল ও গভীর নলকূপ বাসাবাড়িতে একমাত্র ভরসা। খরা মৌসুমে বেশির ভাগ টিউবওয়েলে পানি থাকে না। আন্ডারগ্রাউন্ডের পানি ব্যবহারে সতর্ক না হলে ভবিষ্যতে গভীর নলকূপে পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা নিশ্চিত নয়। গ্রীষ্ম মৌসুমে নগরের তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখার ক্ষেত্রে পুকুরের ভূমিকা থাকলেও সরকারি বিধি-নিষেধ উপেক্ষিত কোনো কোনো ক্ষেত্রে। পুকুর ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণে সামান্যতম ব্যতিক্রম ঘটেনি।
পদ্মার অব্যবহূত চরকে কেন্দ্র করে পর্যটননগরী হিসেবে রাজশাহী গড়ে ওঠার সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। পদ্মাপার দৃষ্টিনন্দন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ভবিষ্যতে কোনো একসময় হয়তো এই পদ্মাপার আর টেমসের পারের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। তার জন্য সঠিক পরিকল্পনা, বিনিয়োগ, সহনশীল মনোভাব ও নিরাপত্তার প্রয়োজন। নদীপথে রাজশাহীর সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ পুনঃস্থাপন দ্রুত হলে উভয় অঞ্চল লাভবান হবে। পণ্য পরিবহনে খরচ অনেক কমে যাবে। শহরের কাজলা জাহাজঘাটে আবারও জাহাজ নোঙর ফেলুক।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়