Home জাতীয় স্নাতক ফার্মাসিস্ট দরকার ১২ হাজার, আছে ৩২৮৬ জন

স্নাতক ফার্মাসিস্ট দরকার ১২ হাজার, আছে ৩২৮৬ জন

নিউজ ডেস্ক

by Nahid Himel

স্নাতক ফার্মাসিস্ট দরকার ১২ হাজার, দেশে আছে মাত্র ৩২৮৬ জন।

দেশে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং টারশিয়ারি ও বিশেষায়িতসহ ৫১৭টি সরকারি হাসপাতাল আছে। যেখানে সেবা নিতে আসা রোগীদের ওষুধ বিতরণে অন্তত ২ হাজার গ্র্যাজুয়েট (স্নাতক) ফার্মাসিস্ট দরকার। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সৃষ্ট ৫২টি গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টের পদের বিপরীতে মাত্র ছয়জন কাজ করছেন। একইভাবে সারা দেশের অন্যান্য সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ১২ হাজার ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট দরকার। যেখানে ৩২৮৬ জন ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট রোগীদের ওষুধ বণ্টনের দায়িত্ব পালন করছেন।

বিশেষজ্ঞরা যুগান্তরকে বলছেন, দেশে বিশ্বমানের অনেক ওষুধ তৈরি হওয়া সত্ত্বেও সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। বিশেষ করে প্রয়োজনীয় ফার্মাসিস্ট সংকটে সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে রোগীদের মধ্যে ওষুধের সুষ্ঠু বণ্টন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া ওষুধ উৎপাদন থেকে বিপণনের বিভিন্ন ধাপে এর মান নষ্ট হচ্ছে। এসব কারণে রোগীর ওপর ওষুধের ভুল প্রয়োগের আশঙ্কা বাড়ছে। অনিরাপদ হচ্ছে রোগীর সামগ্রিক সুরক্ষাব্যবস্থা।

এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যদেশের মতো বাংলাদেশেও আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস-২০২২। এ বছর ওয়ার্ল্ড ফার্মাসিস্ট সোসাইটি কর্তৃক দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো ‘স্বাস্থ্যকর বিশ্বের জন্য ফার্মাসিস্টদের ঐক্যবদ্ধ’। এই প্রতিপাদ্য বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যসেবার ওপর ফার্মাসিস্টের ইতিবাচক প্রভাব নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। পেশাজীবী ফার্মাসিস্টদের মধ্যে সংহতি ও একাত্মতা জোরদার করার কথা বলা হয়েছে। দিবসটি উদযাপনে সরকারি-বেসরকারিভাবে নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-বাংলাদেশ ফার্মাসিস্ট ফোরাম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, অতীশ দিপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয় ও স্টেট ইউনিভর্সিটি অব বাংলাদেশের ফার্মেসি বিভাগের পৃথক র‌্যালি, রচনা ও কুইজ প্রতিযোগিতা, লিফলেট বিতরণ ও আলোচনাসভা। বিভাগ ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালেও সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালিত হবে।

বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলসংশ্লিষ্টরা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, দেশে এই মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন ১৭ হাজার ৯৩৭ জন ‘এ’ গ্রেড ফার্মাসিস্ট রয়েছেন। পাশাপাশি ফার্মেসি কাউন্সিল থেকে তিন বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা পাশ ৫ হাজার ৩৮৯ জন ‘বি’ গ্রেড এবং চার মাসের কোর্স সনদধারী ১ লাখ ৩৮ হাজার ৫৩৮ জন ‘সি’ গ্রেড ফার্মাসিস্ট রয়েছেন। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক সৃষ্ট ডিপ্লোমাধারী ফার্মাসিস্টদের জন্য সারা দেশে ৩ হাজার ৫৫৮টি পদের বিপরীতে মাত্র ২ হাজার ৭০০ জন কাজ করছেন। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সৃষ্ট ৯৬৫টি পদের বিপরীতে ৫৮৬ জন ফার্মাসিস্ট রয়েছেন। এছাড়া ইউনিয়ন সাব-সেন্টার ও ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে ৯ হাজার পদ থাকলেও অধিকাংশ ফাঁকা রয়েছে। একাধিক ফার্মাসিস্ট যুগান্তরকে অভিযোগ করেন, দেশে প্রতিবছর সাড়ে তিন থেকে চার হাজার গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট বেড় হলেও তাদের ৮০ ভাগ সরাসরি ওষুধ উৎপাদনে কাজ করছেন। হাসপাতাল বা ফার্মেসিতে কাজের সুযোগ না পাওয়ায় প্রতিমাসে দেশ ছাড়ছেন অগণিত ফার্মাসিস্ট। চিকিৎসাসেবার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হতে না পারায় রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। যদিও ফার্মাসিস্টদের ওষুধ বিক্রি ও কাউন্সেলিংয়ে কাজে লাগাতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ডিজিডিএ) ৬০০-এর বেশি মডেল ফার্মেসির লাইসেন্স দিয়েছে। কিন্তু নজরদারির অভাবে ৯৫ শতাংশ ফার্মেসিতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট খাতা-কলমে সীমাবদ্ধ থাকছে। সারা দেশে বৈধ-অবৈধ লক্ষাধিক ফার্মেসিতে ডিপ্লোমাধারী ও কোর্সসম্পন্ন ব্যক্তিরা চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই ওষুধ বিক্রি করছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার যুগান্তরকে বলেন, রোগীদের নিরাপদ ওষুধ নিশ্চিতে যেভাবে কাজ হওয়ার কথা তা হচ্ছে না। দেশে যত সংখ্যক ফার্মাকোলজিস্ট ও ফার্মাসিস্ট থাকার কথা তা নেই। অথচ ওষুধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে রোগীদের রক্ষায় চিকিৎসক-নার্সদের সঙ্গে ফার্মাস্টিদেরও ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু হাসপাতালের হেলথ কেয়ার সিস্টেম থেকে ফার্মাসিস্ট কেয়ার-সবখানে ঘাটতি রয়েছে। হাসপাতালগুলোয় ‘এ’ গ্রেডের ফার্মাস্টি থাকা দরকার। এজন্য সরকার প্রতিটি হাসপাতালে ১০টি ‘এ’ গ্রেড ফার্মাসিস্ট পদে নিয়োগের পদক্ষেপ নিচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ৯০ শতাংশ ওষুধ বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনতে হয়। কিন্তু ফার্মেসি কাউন্সিল থেকে এক থেকে তিন মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া ‘সি’ গ্রেডের ফার্মাসিস্টরা ওষুধ বিপণন করছে। এতে অ্যান্টিবায়োটিকের রেজিস্ট্যান্স বা ওষুধের অকার্যকারিতার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, যা রোধে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে ভূমিকা রাখতে হবে। সব হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স, ফার্মাসিস্টদের ফার্মাকোভিজিলেন্সের কাজ করতে হবে। সেই সঙ্গে সার্ভিলেন্সের কার্যক্রম বাড়াতে হবে।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক যুগান্তরকে জানান, তাদের ফার্মেসিতে প্রতিদিন গড়ে সাত হাজার রোগী ওষুধ নেন। অথচ ফার্মেসিতে নিয়োগ পাওয়া চারজনই ডিপ্লোমাধারী। শিক্ষানবিশরাও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা শিক্ষার্থী। একটি ফার্মেসি গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টের তত্ত্বাবধানে থাকার নিয়ম। কিন্তু লোকবল সংকটে একজন চিকিৎসক সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী, কোনো হাসপাতালের প্রতি ৩০টি বিছানার রোগীর বিপরীতে একজন ফার্মাসিস্ট থাকতে হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালে সরকারি হাসপাতালের ফার্মেসিতে একজন এবং প্রতি ৫০ শয্যার বিপরীতে একজন করে ফার্মাসিস্ট নিয়োগের জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগের গড়িমসিতে চলতি বছরে মাত্র ১০ জনের নিয়োগ চূড়ান্ত হলেও তাদের কোথায় কাজে লাগানো হবে, তা এখনো নিশ্চত করা হয়নি।

জনস্বাস্থ্যবিদরা যুগান্তরকে বলেন, ওষুধের দোকান থেকে হাসপাতাল-দক্ষ গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট কোথাও নেই। ফলে ওষুধের অযৌক্তিক ব্যবহার বাড়ছে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় রোগীদের অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে। বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কের একটি অনুষ্ঠানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ওষুধের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) অর্থাৎ মাত্রাতিরিক্ত বা নিয়ম না মেনে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের ফলে রোগীদের শরীরে জীবাণু বা ব্যাকটেরিয়া ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠা বাড়ছে। শরীরে ওই অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারাচ্ছে। একটি বড় ধরনের সংকটে পরিণত হওয়ার আগেই এএমআর ঠেকাতে টেকসই রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, রোগীর জন্য ওষুধের নিরাপত্তার তিনটি দিক রয়েছে। সেগুলো হলো-সরবরাহ থাকতে হবে, সুলভ হতে হবে এবং তা প্রয়োগে কারও ক্ষতি হবে না। এই বিষয়গুলো নিশ্চিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও এর অধীনে থাকা তদারক সংস্থাগুলোকে সক্রিয় হতে হবে। কিন্তু সেই তৎপরতায় ঘাটতি রয়েছে। ওষুধের প্রকৃত দোকানের সংখ্যা ডিজিডিএ বলতে পারছে না। যাদের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, তাদের বাইরে ৪০-৫০ হাজার দোকান রয়েছে। তারাও লাইসেন্সধারীদের মতো ওষুধ বিক্রি করছে। যেখানে কোনো ফার্মাসিস্ট নেই। যেখানে ওষুধ সংরক্ষণের সঠিক ব্যবস্থা নেই। অবস্থা এমন হয়েছে-মুদি দোকান আর ওষুধের দোকানের মধ্যে মানুষ পার্থক্য করতে পারছে না। গেলেই সেখানকার দোকানদার যে কোনো রোগের ওষুধ দিয়ে দিচ্ছে। এ সংকট নিরসনে তদারকি জোরদার করতে হবে। মডেল ফার্মেসিগুলো তাদের শর্ত মানছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।

এই বিভাগের আরো খবর

Leave a Comment