শিল্প খাতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং ব্যাংকগুলোতে ঋণপত্র (এলসি) খোলা সহজ করতে প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা চেয়েছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হবে বলে ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গতকাল বুধবার দেশের ভোগ্য পণ্য উৎপাদনকারী শিল্পোদ্যোক্তা, আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের সঙ্গে গণভবনে মতবিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী।এ সময় ব্যবসায়ীরা তাঁর কাছে এসব সমস্যা সমাধানে সহায়তা চান। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, মেঘনা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোস্তফা কামাল, এসিআই লিমিটেডের এমডি আরিফ দৌলা, দেশবন্ধু গ্রুপের এমডি গোলাম রহমান, টি কে গ্রুপের এমডি মোস্তফা হায়দার, সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের অমিতাভ চক্রবর্তী, সিটি এডিবল অয়েল লিমিটেডের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা, এস আলম গ্রুপের জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক কাজী সালাউদ্দিন আহমেদসহ শীর্ষ ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক সূত্র কালের কণ্ঠকে জানায়, মতবিনিময় অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মূলত পণ্যের আমদানি ও বাজারে সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চেয়েছেন। ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিশদভাবে সমস্যা এবং উত্তরণের উপায়গুলো তুলে ধরেন। গম, তেল, চিনি—এই তিনটি পণ্য আমদানিতে এলসি খুলতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সহযোগিতা এবং এলসি খোলা ও অনুমোদনের ক্ষেত্রে সময়সীমা কমিয়ে আনার বিষয়টি তুলে ধরেছেন ব্যবসায়ীর। সেই সঙ্গে এই তিনটি পণ্যের কাঁচামাল আমদানির পর কারখানায় উৎপাদন করে বাজারজাত করতে কারখানাগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ করার কথা জানানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে।
বৈঠকে উপস্থিত একজন ব্যবসায়ী কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী সবার বক্তব্য শুনেছেন, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। তবে ব্যবসায়ীরা মনে করেন, এই তিনটি পণ্যের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলোর সমাধান করা গেলে আর কোনো সংকট থাকবে না।
জানতে চাইলে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি, গ্যাসের চাপের অভাবে উৎপাদন কম হচ্ছে। ব্যাংকগুলোতে ঋণপত্র বা এলসি খুলতে ব্যবসায়ীদের সমস্যা হচ্ছে। ভোগ্য পণ্য আমদানি করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের বড় বড় এলসি খুলতে হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা জটিল পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন। ব্যাংকগুলো বড় বড় এলসি করতে চায় না। মার্কিন ডলারের মূল্য নিয়েও আমরা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি। এসব সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রী আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। ’
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্য সরবরাহ ও মজুদ নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন। এ ছাড়া ঋণপত্র খোলা নিয়ে ব্যাংকগুলোর অনীহা ও সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা দেওয়ার কথা বলেন। শিল্পে দিনের বেলায় লোড শেডিং না দিয়ে রাতে দেওয়া যায় কি না, সে পরামর্শ দেওয়া হয় বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডকে (আরইবি)।
মতবিনিময়ের বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি কালের কণ্ঠকে বলেন, চলমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দেশে ভোগ্য পণ্যসহ বেশ কিছু বিষয়ে সমস্যা আছে। এসব বিষয়ে ব্যবসায়ীদের কথা শুনেছেন প্রধানমন্ত্রী। সমস্যাগুলো সমাধানে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্ব দেবে। একই সঙ্গে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) ব্যবসায়ীদের বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ীরা ভালো ব্যবসা করেছেন। সংকটের সময় ব্যবসায় লাভ কম করে জনগণের জন্য সেবা হিসেবে নিতে পরামর্শ দিয়েছেন। এ ছাড়া দেশে পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও কেন দাম বাড়ছে, বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্য ও গ্যাস-বিদ্যুৎ নিয়ে যে সংকট চলছে, তা নিরসনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নিজ নিজ দায়িত্ব গুরুত্বের সঙ্গে পালনের পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী জানতে চেয়েছেন, দেশে পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও কিছু পণ্যর দাম কেন বাড়ছে। তিনি বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার পরামর্শ দেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। গ্যাস ও বিদ্যুৎ এবং আমদানি-রপ্তানি সংকট মোকাবেলায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হবে বলেও প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করেন।
বেশি দামে হলেও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি চান ব্যবসায়ীরা
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিনিময়ের পর গতকাল বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) কার্যালয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। বৈঠকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ছাড়াও এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন, হা-মীম গ্রুপের চেয়ারম্যান এ কে আজাদসহ অনেক ব্যবসায়ী নেতা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় টেক্সটাইল মিলে নিরবচ্ছিন্ন ১২ ঘণ্টা, পেপার মিলে ২৪ ঘণ্টা, তৈরি পোশাক কারখানায় ১২ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবি জানানো হয়।
ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, দাম নয়, নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি এখন বেশি প্রয়োজন। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক বাজারের সমান দামে জ্বালানি কিনতে প্রস্তুত আছেন তাঁরা।
সালমান এফ রহমান বলেন, ‘এটি একটি বৈশ্বিক সংকট। এই সংকটে পুরো পৃথিবী সমস্যায় রয়েছে। এককভাবে আমাদের কিছু করার নেই। এর পরও আমরা চেষ্টা করছি, যাতে দ্রুত পরিস্থিতি ঠিক করা যায়। ’
প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘গত বছর সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে যে পরিমাণ গ্যাস শিল্প-কারখানায় দেওয়া হয়েছিল, এবারও ঠিক সেই পরিমাণই গ্যাস দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু শিল্পের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনও বেড়ে গেছে। এতে চাহিদা বাড়ায় জ্বালানিসংকট দেখা দিয়েছে। ’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে শিল্প-কারখানার জন্য গ্যাস ও বিদ্যুতের পৃথক কোনো বিতরণ বা সঞ্চালন লাইন নেই। এ কারণে শিল্পের জন্য আলাদা দাম নির্ধারণ করলেও আলাদা সঞ্চালন এবং বিতরণ লাইনে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব নয়। ’ প্রতিমন্ত্রী বলেন, গাজীপুর-আশুলিয়া-নারায়ণগঞ্জে গ্যাসের চাপের সমস্যা দ্রুত সমাধান করা হবে। এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন ব্যবসায়ীদের সমস্যা যথাযথভাবে চিহ্নিত করার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘বর্তমান সমস্যা বৈশ্বিক। গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করে হলেও আমরা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ চাই। করকাঠামো পুনর্গঠন করলে মূল্য সমন্বয় সহনীয় থাকবে। ’
সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমই, বাংলাদেশ প্লাস্টিকদ্রব্য প্রস্তুতকারক সমিতি, বাংলাদেশ রি-রোলিং মিলস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ স্মল অ্যান্ড ক্যাপটিভ পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও প্রতিনিধিরা।