Home ভ্রমণ সেন্টমার্টিনে ১৪ বছরে পর্যটক বেড়েছে সাড়ে তিনশ শতাংশ ৷৷ ক্ষমতাশালীদের দখলবাজী ঠেকাতে পারছেনা প্রশাসন

সেন্টমার্টিনে ১৪ বছরে পর্যটক বেড়েছে সাড়ে তিনশ শতাংশ ৷৷ ক্ষমতাশালীদের দখলবাজী ঠেকাতে পারছেনা প্রশাসন

নিউজ ডেস্ক

by Nahid Himel

দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে গত ১৪ বছরে পর্যটক বেড়েছে সাড়ে ৩০০ শতাংশ। এ দ্বীপে প্রতিদিন সাড়ে ৪ হাজার পর্যটক ঘুরতে যান। এর মধ্যে ১৬ শতাংশ পরিবেশ সম্পর্কে বেশ সচেতন; ৪১ শতাংশ মোটামুটি সচেতন এবং ৪৩ শতাংশ পর্যটক অনেকটাই অসচেতন। এ অসচেতন পর্যটকরা যেখানে-সেখানে প্লাস্টিকের বর্জ্য ফেলা থেকে শুরু করে নানা অনিয়ম করেন।

সম্প্রতি কক্সবাজারে সেন্টমার্টিনের পরিবেশ, প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও পরিবেশবান্ধব পর্যটন উন্নয়নবিষয়ক কর্মশালায় ইউএনডিপির গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন ইউএনডিপির কান্ট্রি ইকোনমিস্ট নাজনীন আহমেদ। পরিবেশ অধিদপ্তর এ কর্মশালার আয়োজন করে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদের সভাপতিত্বে কর্মশালায় নাজনীন আহমেদ বলেন, সেন্টমার্টিনে টেকসই পর্যটনের চিন্তা করতে হবে। এ দ্বীপ নিয়ে পলিসি, অ্যাডভোকেসি ও ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিকিউরিটি সাপোর্ট নিয়ে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে দ্বীপের বাসিন্দাদেরও কাজে লাগাতে হবে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফারহিনা আহমেদ বলেন, পরিবেশকে কমিটমেন্টের জায়গায় নিয়ে এসেছে সরকার।

তিনি বলেন, পরিবেশের পাশাপাশি ট্যুরিজমও চাই, যাতে উন্নয়ন টেকসই হয়। কারণ, মানুষের মতো সব জীবের বেঁচে থাকার অধিকার আছে।

ফারহিনা আহমেদ আরও বলেন, মানুষের সংবেদনশীলতার অভাবে দ্বীপটি আজ বিপন্ন। এ কারণে পর্যটকদের সংবেদনশীল হতে হবে, যাতে দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের পাশাপাশি শৈবাল, প্রবাল ও কেয়াগাছ নষ্ট না হয়।

কর্মশালায় আরও বক্তব্য দেন কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক সৈয়দা মাসুমা খানম, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সচিব আবু জাফর রাশেদ, কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী, সাংবাদিক নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাত, সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান প্রমুখ

অন্যদিকে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে জলজ, উভয়চর প্রাণী এবং পাখিসহ নানা জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নেয়া হচ্ছে মহাপরিকল্পনা। অতিরিক্ত পর্যটকের চাপ,ক্ষমতাশালীদের  অপরিকল্পিতভাবে হোটেল-মোটেল নির্মাণ, নির্বিচারে গাছ কেটে বন উজাড় করা, প্লাস্টিকসামগ্রীর বর্জ্যসহ বিভিন্ন কারণে দ্বীপের নানা প্রজাতির প্রাণীকুল বিলুপ্ত হওয়ার পথে। এ ছাড়া পর্যটকদের পানির চাহিদা মেটাতে বৈদ্যুতিক পাম্প বসিয়ে ভূগর্ভস্থ মিষ্টি পানি উত্তোলনসহ পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের কারণে হুমকির মুখে রয়েছে কোরালসহ জীববৈচিত্র্য। সরকারি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়,  প্রবাল দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। বিআইডব্লিটিএর সচিব মোহাম্মদ আবু জাফর হাওলাদার সেন্টমার্টিন রক্ষায় একটি চিঠি পাঠিয়েছেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে। চিঠিতে বলা হয়েছে, সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা এবং টেকসই পর্যটন উন্নয়নে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে।

মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটকদের রাত্রিযাপন নিরুৎসাহিত করা; যদি কোনো পর্যটক একান্তই সেখানে রাত কাটাতে চান, তাহলে জাহাজে বা নৌযানে অবস্থান করা এবং টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত নৌরুট এবং সেন্টমার্টিন এলাকাকে অর্থনৈতিক সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় দুর্যোগকালীন পর্যটকদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটকদের জন্য আরোহণ ও অবরোহণের জন্য আন্তর্জাতিক মানের জেটি স্থাপন করা।

এ বিষয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহম্মদ মেজবাহ্‌ উদ্দীন চৌধুরী সমকালকে বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপ পর্যটকদের জন্য একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান। কিন্তু প্রাকৃতিক কারণে এবং পর্যটকদের অসচেতনার ফলে প্রবাল দ্বীপটি হুমকির মুখে। এটি রক্ষায় কাজ শুরু হয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে সরকার। স্বচ্ছ পানি ও চারপাশজুড়ে প্রবাল পাথরবেষ্টিত মনোলোভা পুরো দ্বীপটিই যে নৈসর্গ। বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমার সীমান্তের পার্শ্ববর্তী ৮ দশমিক ৩ বর্গকিলোমিটারজুড়ে এটির অবস্থান। দেশের একমাত্র এই প্রবাল দ্বীপ সামুদ্রিক কাছিমের প্রজনন ক্ষেত্রও। এখানে ৬৮ প্রজাতির প্রবাল, ১৫১ প্রজাতির শৈবাল, ১৯১ প্রজাতির মোলাস্ট বা কড়ি জাতীয় প্রাণী, ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, পাঁচ প্রজাতির ডলফিন, চার প্রজাতির উভচর প্রাণী, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী, ১২০ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১৭৫ প্রজাতির উদ্ভিদ, দুই প্রজাতির বাদুড়সহ নানা প্রজাতির বসবাস ছিল। এসব প্রজাতির অনেকগুলো এখন বিলুপ্তির পথে। জলবায়ু পরিবর্তনের কঠিন সময়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এসব জীববৈচিত্র্য। অতিরিক্ত পর্যটক দ্বীপের ভারসাম্য এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছেন।
দ্বীপটিতে প্রায় নয় হাজার স্থায়ী বাসিন্দা বসবাস করে। প্রতিদিন গড়ে আরও নয় হাজার পর্যটক সেখানে অবস্থান করেন। এতে ১৮ হাজার মানুষের চাপ নিতে হয় দ্বীপটিকে। এ কারণে প্রকৃতির রূপ-সৌন্দর্য হারাতে বসেছে দ্বীপটি।

এ প্রসঙ্গে পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ সিপিআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুদ্দোহা বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপের বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ আরও অনেক আগে নেওয়া উচিত ছিল। প্রবাল দ্বীপ বাঁচাতে হলে রাতে পর্যটকরা সেখানে থাকতে পারবে কিনা কিংবা বছরের কোন মৌসুমে পর্যটকদের জন্য এটি উন্মুক্ত থাকবে, সেটা আগে ঠিক করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, শুধু পর্যটক নন; সেখানে যারা স্থায়ী বাসিন্দা রয়েছেন তারাও পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি। স্থায়ী বাসিন্দা দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু এই দ্বীপের ধারণক্ষমতা কতটুকু সেটাও গবেষণা করে নির্ধারণ করে দিতে হবে। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় শুধু আইন করলে হবে না, সেটার প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। দ্বীপটি রক্ষায় নিয়মিত তদারকি দরকার।

এই বিভাগের আরো খবর

Leave a Comment