Home রাজনীতি কার্যালয়-কার্যক্রম- কোনটিই নেই অনেক দলের

কার্যালয়-কার্যক্রম- কোনটিই নেই অনেক দলের

নিউজ ডেস্ক

by Nahid Himel

রাজধানীর সেগুনবাগিচার তোপখানা রোড। বাড়ি নম্বর ২৭/৮। নিচ তলায় প্রিন্টিং প্রেস এবং দোতলায় কাজী অফিস ও একটি ট্রাভেল এজেন্সির কার্যালয়। তিন তলায় অফিসটি তালাবদ্ধ। ওই অফিসটি সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আজিজ সরকারের ল’ চেম্বার। তিনি এ ভবনেরও মালিক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে গুরুতর অসুস্থ। এই ল’ চেম্বারটিকে কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসাবে উল্লেখ করেছে ‘বাংলাদেশ জনমত পার্টি’। এটিকে সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয় দেখিয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে নিবন্ধনও চেয়ে আবেদন করেছে দলটি। এতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কার্যালয় রয়েছে বলেও আবেদনে উল্লেখ করেছে। সরেজমিন পরিদর্শন ও অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।

আরও জানা গেছে, শুধু ল’ চেম্বার নয়, মিউজিক প্রতিষ্ঠান, চাকরিস্থল, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্রীয় কার্যালয় দেখিয়ে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন চেয়েছে আরও বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। অথচ ওইসব স্থানে রাজনৈতিক কোনো কার্যকলাপও পরিচালিত হয় না। বেশ কয়েকটি দল রয়েছে যেগুলোর দলীয় কার্যক্রম ও কার্যালয়ও নেই। সাম্প্রতিক সময়ে গড়া কয়েকটি দলও নিবন্ধন পেতে আবেদন করেছে। আবার এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে। ন্যাপ (ভাসানী), বাংলাদেশ আওয়ামী পার্টি (ভাসানী ন্যাপ)সহ কয়েকটি পুরোনো রাজনৈতিক দলও নিবন্ধন চেয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের  দেয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নিবন্ধন পেতে এবার সর্বোচ্চ ৯৮টি রাজনৈতিক দল আবেদন করেছে। যদিও রোববার নির্বাচন কমিশন ৮০টি দল আবেদন জমা দিয়েছে বলে জানিয়েছিল। এর আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ৭৬টি দল আবেদন করলেও ইসি একটিকেও নিবন্ধন দেয়নি। যদিও পরে আদালতের রায়ে দুটি দলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। বর্তমানে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৩৯।

ইসির সংশ্লিষ্টরা জানান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও) এর অনুচ্ছেদ ৯০ অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনে একটি দল নিবন্ধন পেতে হলে তিনটি শর্তের যেকোনো একটি পূরণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর মধ্যে একটি শর্ত হচ্ছে-ওই দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ও একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয় থাকতে হবে। এছাড়া অন্তত ২১টি জেলা ও একশ উপজেলা বা থানায় কার্যালয় থাকতে হবে। প্রতিটি কার্যালয়ে ন্যূনতম দুইশ ভোটারের তালিকা থাকার বিধান রয়েছে। তারা জানান, অনেক সংগঠন কেন্দ্রীয় ও জেলা-উপজেলা কার্যালয় সম্পর্কে অসত্য তথ্য দিয়ে নিবন্ধন পাওয়ার চেষ্টা করছে। কারণ দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিতে হলে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

তবে তথ্য গোপন করে নিবন্ধন পাওয়ার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ। সোমবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, যেসব দল শর্ত পূরণ করবে তারা নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হবে। আইন ও বিধিমালায় যেসব শর্ত রয়েছে সেগুলো দলগুলো পূরণ করেছে কি না তা যাচাইয়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে। ওই কমিটি তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে। নির্বাচন কমিশন মাঠ পর্যায়ের কার্যালয় অনুসন্ধানের নির্দেশনা দিলে সেই অনুযায়ী তা যাচাই করা হবে। তিনি বলেন, অতীতে রাজনৈতিক দলের মাঠ পর্যায়ের কার্যালয় যাচাই করেই নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছিল।

ল’ চেম্বারকে দলীয় কেন্দ্রীয় কার্যালয় দেখানোর বিষয়টি প্রকারান্তরে স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ জনমত পার্টির আহ্বায়ক সুলতান জিসান উদ্দিন প্রধান। তিনি বলেন, নিবন্ধন পাওয়ার পর দলীয় কার্যালয় নেব। নিবন্ধন না পেলে অফিস নিয়ে ভাড়া গুনে কী লাভ? তিনি দাবি করেন, ৪৪টি জেলা ও ১০৯টি উপজেলায় তার দলের কমিটি আছে। ২২টি জেলা ও ৫৭টি উপজেলায় দলীয় কার্যালয় রয়েছে। ২০২০ সালের ১৮ মার্চ এ দলের প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

আরও জানা গেছে, রাজধানীর তোপখানা রোডের মেহেরবা প্লাজা ভবনে কয়েকটি দল তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় রয়েছে বলে আবেদনে উল্লেখ করেছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক মুক্তি আন্দোলন (বিজিএমএ) ও নতুন ধারা বাংলাদেশ (এনডিবি)। সরেজমিনে দেখা গেছে, ওই ভবনে কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যালয় নেই। পুরো ভবনটি বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক মুক্তি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসাবে যেটিকে দেখিয়েছে মূলত সেটি হচ্ছে ‘নবচেতনা’ নামের একটি গণমাধ্যম অফিস। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিজিএমএ’র চেয়ারম্যান মো. আশরাফ হাওলাদার নিজেকে একজন গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি বলেন, যেহেতু ওই অফিসে চাকরি করেন তাই সেটির ঠিকানা উল্লেখ করেছেন। তিনি দাবি করেন, ২১ জেলা ও ৫০ উপজেলায় তার দলের কার্যালয় রয়েছে। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ‘নবচেতনা’র সার্কুলেশন ম্যানেজার পরিচয় দেওয়া জয়নাল আবেদীন বলেন, মো. আশরাফ হাওলাদার ওই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তবে তিনি কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে গণমাধ্যম অফিসকে দলীয় অফিস দেখিয়েছেন কি না তা তার জানা নেই। তবে একটি সূত্র জানায়, মো. আশরাফ হাওলাদার যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ওই সুবাদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের একটি ছবি দিয়ে পোস্টারও ছাপিয়েছিলেন।

আরও দেখা গেছে, নতুনধারা বাংলাদেশ’র কেন্দ্রীয় কার্যালয় দেখানো হয়েছে সেটি সাউন্ডবাংলা নামের একটি মিউজিক প্রতিষ্ঠানের এক রুমবিশিষ্ট অফিস। ওই অফিসের কর্ণধার এ দলের চেয়ারম্যান মোমিনুল ইসলাম মেহেদী। এ দলের সিনিয়র সহ-সভাপতি তারই স্ত্রী শান্তা ফারজানা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোমিনুল ইসলাম মেহেদী বলেন, ৭১/১ শান্তিনগরে তার দলীয় কার্যালয় রয়েছে। যেহেতু তিনি এ প্রতিষ্ঠানেই বসেন, তাই এটিকে দলীয় কার্যালয় দেখিয়ে নিবন্ধনের আবেদন করেছেন। তিনি দাবি করেন, বরিশাল, ভোলা, পিরোজপুর, টাঙ্গাইলসহ ২০টি জেলা এবং ৯০টি উপজেলায় তার দলীয় কার্যালয় রয়েছে।

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন পেতে এবারও আবেদন করেছে ‘নাকফুল বাংলাদেশ’ নামের একটি রাজনৈতিক দল। এ দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসাবে দেখিয়েছে রাজধানীর উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের বিএনএস সেন্টারের ১০ম তলা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সেখানে কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যালয় নেই। রাজনৈতিক কোনো কার্যক্রমও সেখানে পরিচালিত হয় না। যেই কক্ষটিকে দলীয় কার্যালয় হিসাবে দেখানো হয়েছে, সেটি একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। আর সেটির মালিক আবদুর রহমান নামের একজন ব্যক্তি। অথচ গতবারের মতো এবারও এটিকেই রাজনৈতিক দলের অস্থায়ী কার্যালয় দেখিয়ে নিবন্ধন চেয়েছে ‘নাকফুল বাংলাদেশ’। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দলটির চেয়ারম্যান স্বপন রেজা যুগান্তরকে বলেন, ভুলক্রমে তিনি ওই ঠিকানা অফিস হিসাবে দেখিয়েছেন। ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক এক সময়ে তার দলের পদে থাকলেও তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি বলেন, এবার নির্বাচন কমিশন তার দলকে নিবন্ধন না দিলে তিনি উচ্চ আদালতে যাবেন। আর নিবন্ধন পেলে এক মাসের মধ্যে সবজেলায় দলীয় কার্যালয় নেবেন।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, রাজধানীর পুরানা পল্টনের বায়তুল আবেদ ভবনের ৮০৪ নম্বর স্যুটে দলীয় কার্যালয় থাকার কথা জানিয়েছে ‘নৈতিক সমাজ’ নামের একটি রাজনৈতিক দল। ওই ভবনে গিয়ে দেখা গেছে, ওই স্যুটের সামনে দলের নাম লেখা রয়েছে। গতকাল বিকালে ওই স্যুটটি তালাবদ্ধ ছিল। তবে ভবনের কার্যালয়ের তালিকায় ৮০৪ নম্বর স্যুটটি ‘রূপম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল’ প্রতিষ্ঠানের নামে রয়েছে। স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ দলের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আমসাআ আমিন। এক সময়ে তিনি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন। সম্প্রতি ওই স্যুটের সামনে দলের নাম লেখা হয়েছে। মেজর জেনারেল (অব.) আমসাআ আমিন যখন আসেন তখন ওই অফিসটি খোলা হয়। অন্য সময়ে বন্ধ থাকে।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম নামের একটি রাজনৈতিক দল তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানা উল্লেখ করেছে ৫৫/১ নম্বর পুরানা পল্টনকে। ওই ঠিকানায় গিয়ে দেখা গেছে, সেটি ইসলাম এস্টেট নামের একটি বহুতল ভবন। সেখানে বাণিজ্যিক অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে সেখানে রাজনৈতিক দলের কার্যালয় থাকার কথা জানেন না ওই ভবনের অন্য প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা। এ বিষয়ে জানতে দলটির আহ্বায়ক ড. আবদুর রহমানের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

ইসির কর্মকর্তারা জানান, আরপিও অনুযায়ী, নিবন্ধন পেতে হলে তিনটি শর্তের যেকোনো একটি শর্ত পূরণ করতে হয়। শর্তগুলো হলো-১. দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে কোনো জাতীয় নির্বাচনের আগ্রহী দলটি যদি অন্তত একজন সংসদ সদস্য থাকেন; ২. যে কোনো একটি নির্বাচনে দলের প্রার্থী অংশ নেওয়া আসনগুলোয় মোট প্রদত্ত ভোটের ৫ শতাংশ পায়। ৩. দলটির যদি একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, দেশের কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ [২১টি] প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর কমিটি এবং অন্তত ১০০টি উপজেলা/মেট্রোপলিটন থানায় কমপক্ষে ২০০ ভোটারের সমর্থন সংবলিত দলিল থাকে।

এই বিভাগের আরো খবর

Leave a Comment