তের বছর আগে সিদ্ধান্ত হয়, ২০২০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলো প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার গরিব দেশগুলোকে দেবে। সেই প্রতিশ্রুতি রাখেনি তারা। দক্ষিণ এশিয়া ঠিকই জলবায়ু পরিবর্তনের মূল্য দিচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যে কতটা ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়ছে বিশ্ব ব্যাংকের এক পরিসংখ্যানে তা বোঝা যেতে পারে। টাকার অংক উল্লেখ করে সংস্থাটি বলছে, চলতি দশকের শেষে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বছর প্রতি ১৬ হাজার কোটি ডলার ক্ষতির মুখে পড়বে। আর আগামী তিন দশক মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই অঞ্চলের চার কোটি লোক বাস্তুচ্যুত হবে।
জার্মানির পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন জার্মান ওয়াচের এক গবেষণায় দেখা গেছে, চলতি শতকের প্রথম দুই দশকে বিশ্বের যে কয়টি দেশ দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে তার প্রথম দশটি দেশের তিনটিই হলো দক্ষিণ এশিয়ার। দেশগুলো হলো বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও নেপাল। পরের দশ দেশের তালিকায় আছে দক্ষিণ এশিয়ার আরো দুই দেশ- ভারত ও আফগানিস্তান।জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জনসংখ্যায় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ভারতে পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। শুধু ২০২১ সালেই দেশটি ১৯টি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে পড়েছে। এই সময়ে এশিয়ার দেশগুলোতে মোট ১৭৪টি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা ঘটেছে।জলবায়ু এই পরিবর্তন বিবেচনায় দেখা যায় দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ পাকিস্তানের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। দেশটির ৩ কোটি ৩০ লাখ লোক চলতি বছর নানা ধরনের প্রাকৃতির দুর্যোগের কারণে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। আর ভয়াবহ বন্যার কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তরাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং তাদের জীবন জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ টমাস মাইকেল কের বলেন, পাকিস্তানের ভয়াবহ বন্যার পর পুনর্গঠনের জন্য এক হাজার ছয়শ’ কোটি ডলার প্রয়োজন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় সম্প্রতি আঘাত করা হারিকেন ইয়ানের সঙ্গে আমি পাকিস্তানের বন্যার তুলনা করতে চাই। দু’টোই অনেক ভয়াবহ ছিল। কিন্তু ফ্লোরিডার চেয়ে পাকিস্তানের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।দাবদাহ, সাইক্লোন, খরা এবং বন্যার তীব্রতা মাথায় নিয়ে টিকে আছে দক্ষিণ এশিয়ার লোকেরা। এসব দুর্যোগ এত ঘন ঘন হচ্ছে যে, এগুলো এই অঞ্চলের মানুষের কাছে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অংশ হয়ে উঠেছে।পাকিস্তানে বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিভিন্ন ঘটনার বিষয়ে দেশটির একজন তরুণ পরিবেশকর্মী ও জাতিসংঘের গুডউইল অ্যাম্বাসাডর আলিজা আয়াজ বলেন, এটা খুব কষ্টের। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় ছিলেন। মনে হচ্ছিল যদি ঘটনাস্থলে থেকে আমি মানুষকে সাহায্য করতে পারতাম। আমার যদি এতটা ক্ষমতা ও প্রভাব থাকত যে আমি তাদের ঠিকমত সহযোগিতা করতে পারতাম, তাতে হয়ত অনেকের জান বাঁচত।
ভুক্তভোগী লোকদের জন্য একটি টেকসই সমাধানের আশায় আয়াজের মতো পরিবেশকর্মীরা এবং জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা চলতি বছরের জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৭-এর দিকে তাকিয়ে আছেন। কারণ ২০১৫ সালে প্যারিসের জলবায়ু সম্মেলনে হওয়া বিভিন্ন চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়ায় উদ্বেগ রয়ে গেছে।ভারতের সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের পলিসি রিসার্চার অভন্তিকা গোস্বামী বলেন, খোদ প্যারিস চুক্তিতে ন্যায্যতা রাখা হয়েছে বলে ভুল ধারণা রয়েছে। কারণ সেখানে কার্বন নিঃসরণ কমানোর দায় ধনী গরীব সব দেশের ওপর সমানভাবে চাপানো হয়েছে। এই অন্যায্যতা আরো বাড়বে। কারণ গরীব ও ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো একটা সংকটে ভুগছে যার দায় একেবারেই তাদের নয় এবং ঘুরে দাঁড়াবার জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণও পাচ্ছে না।প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী, ২০২০ সালের পর থেকে জলবায়ু অর্থায়নের অংকটি বছর প্রতি একশ’ বিলিয়ন বা দশ হাজার কোটি ডলার হওয়ার কথা। কিন্তু এখনো এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি ধনী দেশগুলো।
উন্নত দেশগুলোর দাবি, ২০২০ সালে সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে মোট আট হাজার তিনশ ত্রিশ কোটি ডলার প্রদান করা হয়েছে। তবে ব্রিটিশ বেসকারি সংস্থা অক্সফাম বলছে, এই তহবিলের প্রকৃত অংক দুই হাজার তিনশ’ থেকে দুই হাজার ৪৫০ কোটি ডলার।ধারণা করা হচ্ছে, চলতি বছরের সম্মেলনে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কীভাবে অভিযোজন করা যায় সে সমস্যা সমাধানে উপর জোর প্রদান করা হবে। তাছাড়া অভিযোজনের জন্য বিভিন্ন গোষ্ঠি কীভাবে সহজে অর্থনৈতিক সুবিধা লাভ করতে পারে সে বিষয়টিও সহজ করা হবে।ঢাকাস্থ ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পরিচালক সালীমুল হক বলেন, প্রশমন প্রকল্পের জন্য জলবায়ু বিষয়ক যে তহবিল আসে তা মূলত নবায়নযোগ্য প্রকল্প যেমন সোলার, বায়ু শক্তি ইত্যাদি খাতে দেওয়া হয়। এসকল প্রকল্প লাভজনক তাই এখানে ঋণ প্রদান করা হয়। আর এ কারণে উন্নত দেশগুলো প্রশমন প্রকল্পের বিষয়ে বেশি আগ্রহী। অন্যদিকে অভিযোজন তহবিল সাধারণত আক্রান্ত এলাকা যেমন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দুর্গত লোকেদের টিকে থাকবার জন্য সাহায্য হিসেবে দেয়ার কথা।
এদিকে, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ গোস্বামীর মতে, কপ-১৫ সম্মেলনে বছরপ্রতি ১০ হাজার কোটি ডলার দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা অনেকটাই অবিবেচনাপ্রসূ। তিনি বলেন, কপ-২৭ সম্মেলন অবশ্যই ২০২৫ সাল থেকে নতুন করে তহবিলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে যেন তা প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণে সক্ষম আর বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ কের বলেন, জলবায়ু সহিষ্ণু হওয়ার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের ব্যাপারে আমাদেরকে নতুন পথ খুঁজে বের করতে হবে।
তার আশা, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য কীভাবে অর্থায়ন বাড়ানো যেতে পারে সে বিষয়ে চিন্তা করতে সম্মেলনে সবাইকে একত্রিত করা যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো সম্প্রতি ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ নামে একটি তহবিল গঠনের চেষ্টা করছে। মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে অভিযোজন এবং প্রশমনের জন্য প্রকল্প হাতে নেওয়া ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের পুনর্বাসনের জন্যও মোটা অংকের অর্থনৈতিক সযোগিতা প্রয়োজন।
সালীমুল হক জানান, মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে পাকিস্তানের বণ্যা দ্বিগুণ ভয়াবহ হয়েছে উঠেছে। তিনি বলেন, অভিযোজন এবং প্রশমন প্রকল্পগুলো ব্যর্থ হয়েছে। মানুষ ক্ষতির মুখে পড়ছে। তাদের সহযোগিতা দরকার। আর এ জন্য আমাদের তহবিল দরকার।
এদিকে লস অ্যান্ড ডেমেজ তহবিলের বিষয়টি এখনো কপ-২৭-এর মূল আলোচ্যসূচিতে স্থান পায়নি। মূল আলোচনায় স্থান পেতে হলে সম্মেলনের শুরুতেই তা ভোটাভুটির মাধ্যমে এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর চাপ অব্যাহত আছে।
ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান সালীমুল হক বলেন, যেকোনো একটি দেশও এই প্রস্তাবনার বিষয়ে আপত্তি তুলতে পারে এবং তা থামিয়ে দিতে পারে। আর এমন হলে এটি নিয়ে রীতিমত বাকযুদ্ধ শুরু হবে এবং শুরু হওয়ার আগেই কপ-২৭ ব্যর্থ বলে গণ্য হবে।
তিনি বলেন, মানবসৃষ্ট কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে দুর্যোগ ঘটছে সে বিষয়ে আমাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। আইপিসিসির ষষ্ঠ প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, মানবসৃষ্ট কারণে কার্বণ নিঃসরণ বেড়ে যাওয়ায় এই পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। এই বাস্তবতা প্রমাণের পর কপ-২৭ প্রথম সম্মেলন। আর এ সম্মেলন চলমান সমস্যার সমাধান আসতে হবে।