Home ব্যবসাপাতি আইএমএফ’র ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ ৷৷ মন্দের চেয়ে ভালোই বেশি

আইএমএফ’র ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ ৷৷ মন্দের চেয়ে ভালোই বেশি

নিউজ ডেস্ক

by Nahid Himel

বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এই ঋণের ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে।তবে এ মুহূর্তে ঋণের প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে বিদেশে ইতিবাচক বার্তা যাবে, যা বিদেশি কম সুদের ঋণ পেতে সহায়ক হবে।

সরকার আর্থিক খাত সংস্কার শুরু করতে বাধ্য হবে। মন্দদিকের মধ্যে রয়েছে-ঋণের শর্তের কারণে জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে; যা মূল্যস্ফীতির হারও আরও চাপে ফেলবে।মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে। আমদানি পণ্যের শুল্ক কমানোর কারণে দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। আইএমএফ-এর ঋণের ওপর ভর করে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না।এতসবের পরও এ ঋণে মন্দের চেয়ে ভালো দিকই বেশি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

এদিকে আন্তর্জাতিক সংস্থাটির চাপে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বুধবার জানিয়েছেন, ‘গ্রস রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন তহবিলে বরাদ্দ ৮০০ কোটি ডলার বাদ দিলে নিট রিজার্ভ হবে।’বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব এবং দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির কারণে সৃষ্ট বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবিলায় সরকার আইএমএফ-এর কাছে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ চায়।এ বিষয়ে আইএমএফ মিশন বাংলাদেশে দুই সপ্তাহ অবস্থান করে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করে বুধবার একটি সমঝোতায় এসেছে। সংস্কারের কিছু শর্তে আইএমএফ ঋণ ছাড় দেবে।আগামী মার্চে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠেয় আইএমএফ-এর নির্বাহী বোর্ডের সভায় বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণ মঞ্জুরের প্রস্তাব অনুমোদন পেতে পারে।সাধারণত মিশন কোনো দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশেষণ করে যে প্রস্তাব করে, বোর্ড ওই প্রস্তাবেই সায় দেয়।

সূত্র জানায়, অর্থনীতি চাপমুক্ত থাকলে সাধারণত কোনো দেশ আইএমএফ-এর ঋণের মুখাপেক্ষী হয় না। কারণ তাদের ঋণের পরিমাণ কম, দীর্ঘমেয়াদি কিস্তিতে বিতরণ করে, অনেক শর্ত আরোপ করে; যা অনেক ক্ষেত্রে সরকারের জন্য অজনপ্রিয়।কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে পড়লেই আইএমএফ-এর কাছে ঋণের জন্য দ্বারস্থ হয় কোনো দেশ। কারণ, তাদের কাছ থেকে ঋণ পেলে অন্যান্য সংস্থার ঋণ পাওয়া সহজ হয়।কেননা আইএমএফ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কঠোরভাবে মূল্যায়ন করেই ঋণের অনুমোদন দেয়। তাদের ঋণের কিছু শর্ত অজনপ্রিয় হলেও সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ইতিবাচক। আইএমএফ বাংলাদেশকে যে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে, এর ভালো দিকগুলো হচ্ছে-এই ঋণের ফলে সাময়িকভাবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কিছুটা হলেও কমবে।তাদের ঋণ ছাড় হলে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়বে। আইএমএফ সার্বিক অর্থনীতির চুলচেরা বিশেষণ করেই ঋণ দেয়।অর্থনীতিকে সঠিক পথে আনার শর্ত মেনে নিলেই ঋণ মিলবে, অন্যথায় নয়। ফলে আইএমএফ-এর ঋণ পাওয়া মানেই অর্থনীতি সংকট থেকে উত্তরণের দিকে যাবে।এই বার্তাটি বহির্বিশ্বে গেলে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে। তখন বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ অন্য ঋণদাতা সংস্থাগুলোও আইএমএফ-এর মূল্যায়নকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে।

আইএমএফ কোনো দেশকে ঋণ দিলে তারাও ঋণ দিতে কার্পণ্য করে না। ফলে তাদের কাছ থেকেও ঋণ পাওয়া সহজ হবে। এতে বৈদেশিক ঋণের বহুমুখী দুয়ার খুলবে।এতে ডলারের প্রবাহও বাড়বে। বিদেশি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা করপোরেট সংস্থা থেকে বাণিজ্যিক ঋণ দিতে গেলে দরকষাকষিতে আইএমএফ-এর মূল্যায়ন ইতিবাচক হয়।ফলে এ খাতেও ঋণের চড়া সুদ বা কঠিন শর্ত চাপিয়ে দেয়ার সুযোগ মিলবে না। ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য দেশের অর্থনীতিবিদ ও সুশীল সমাজ দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে।তারা এজন্য একটি শক্তিশালী ব্যাংক সংস্কার কমিশন গঠনের দাবিও তুলেছেন। কিন্তু সরকার এটি করছে না। আইএমএফ-এর ঋণের অন্যতম একটি শর্ত হচ্ছে-ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে সংস্কার বাস্তবায়ন।এতে সরকার চাপে পড়ে হলেও আর্থিক খাত সংস্কারে কাজ করবে। এতে এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে। এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আইএমএফ ঋণের ক্ষেত্রে যেসব শর্ত দিয়েছে, সেগুলো নিজ থেকেই করা উচিত। আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।তা না হলে আর্থিক খাতের দুর্বলতায় অর্থনীতি আক্রান্ত হবে। জ্বালানি তেল, গ্যাসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে বাড়ানো বা কমানো উচিত। এ ধরনের কাঠামো করতে হবে আগে।তারপর এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে শুল্ক কাঠামোতে পরিবর্তন আনার একটি চাপ আছে। এটি করলে দেশের শিল্পের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।তাদের সব শর্ত যে মানতে হবে, এমনটা নয়। তবে এবার সরকার বেশ ভালোভাবেই দরকষাকষি করেছে।

সূত্র জানায়, আইএমএফ-এর ঋণের মন্দদিকের মধ্যে রয়েছে-তাদের ঋণ নেওয়ার মানেই হচ্ছে দেশটি সংকটে আছে। অনেকে এটিকে মন্দা মোকাবিলার জন্য ‘বেলআউট প্রোগ্রাম’ হিসাবে মনে করে।বাংলাদেশ, পাকিস্তান মন্দার মোকাবিলায় আইএমএফ-এর ঋণ চাওয়ার পরই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদ পরিবেশন হয়েছে, দেশ দুটি আইএমএফ-এর কাছে বেলআউট চেয়েছে।অবশ্য এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে ওই সময়েই অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, বাংলাদেশ আইএমএফ-এর কাছে কোনো বেলআউট প্রোগ্রাম চায়নি। ঋণ চেয়েছে। আইএমএফ এবার ঋণ দেবে সাত কিস্তিতে। প্রথম কিস্তিতে দেবে ৪৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এটি মার্চে ছাড় হতে পারে। বাকি ছয় কিস্তি দেবে ছয় মাস পরপর প্রতি কিস্তিতে ছাড় করবে ৬৭ কোটি ৫৫ লাখ ডলার করে। দেশের আমদানি ব্যয় মাসে গড়ে ৬৫০ কোটি ডলার। ফলে এ ঋণ বৈদেশিক মুদ্রা সংকট মোকাবিলায় খুব বেশি ভূমিকা রাখবে না।কারণ বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার মাসে ঘাটতি প্রায় ২০০ কোটি ডলার। প্রতি ছয় মাস পর ঋণ মিলছে মাত্র ৬৭ কোটি ডলার। এছাড়া তারা পুরো ঋণ ছাড় করবে ২০২৬ সালের মধ্যে।তবে আইএমএফ-এর ঋণ পেলে অন্য বহুজাতিক সংস্থাগুলোর ঋণ পাওয়া সহজ হবে। কিন্তু আইএমএফ-এর ঋণের ওপর ভর করে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। আইএমএফ-এর ঋণের এবারের সুদের হার বেশি। অন্যান্য ঋণে তাদের সুদের হার ১ থেকে দেড় শতাংশের মধ্যে থাকে। এবার ঋণের সুদ ২ দশমিক ২০ শতাংশ, যা বেশ বেশি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। আইএমএফ ঋণের শর্ত হিসাবে জ্বালানি তেল, গ্যাস বিদ্যুতের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে বলেছে। সব খাতেই বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দেশে দাম কম রয়েছে।এ কারণে এসব পণ্যের দাম বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার সময় নিয়েছে। তারাও বেশি চাপ দেয়নি। তবে এগুলোর দাম বাড়ালে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বেড়ে যাবে।বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের কাছাকাছি। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দামও এখন লাগামছাড়া। ফলে এগুলোর দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতির হার আরও বেড়ে যাবে। সংস্থাটি ট্যারিফ যৌক্তিককরণ করতে বলেছে। এর মানে হচ্ছে আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক কমাতে হবে। এতে দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ এগুলো হচ্ছে অর্থনীতির লাইফ লাইন।এগুলোর দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই সব খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সবকিছুর দাম বেড়ে যায়। জীবনযাত্রার মান কমে যায়। এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতির হার বাড়বেই।এ কারণে এবার এসব শর্ত নিয়ে আইএমএফ বেশ নমনীয়। এছাড়া সরকার আগেই জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে।

তবে আর্থিক খাতে যেসব সংস্কারের কথা তারা বলেছে, সেগুলো ইতিবাচক। চাপে পড়ে যদি আন্তরিকভাবে এসব সংস্কার হয়, তাহলে আর্থিক খাত লাভবান হবে। তবে কতটুকু সংস্কার হবে, তা দেখার বিষয়। সূত্র জানায়, আইএমএফ ঋণ অনুমোদন করলেও তাদের দেওয়া শর্তের ওপর নজর রাখবে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে কিছু তথ্য চেয়েছে, সেগুলো চলতি মাসের মধ্যে দিতে অনুরোধ করেছে।এছাড়া জ্বালানি খাতেও বেশকিছু তথ্য চেয়েছে। এর মাধ্যমে তারা আইএমএফ-এর সঙ্গে সরকারের সমঝোতা অনুযায়ী কাজ করছে কি না, সেদিকেও নজর রাখবে।

জানা যায়, আইএমএফ-এর কাছ থেকে ঋণের কয়েক কিস্তি নিয়ে চুক্তির আওতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার নজিরও রয়েছে। এ ধরনের আলোচনা সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যেও রয়েছে।করোনার সময় ২০২০ সালে বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে ৭২ কোটি ডলারের ঋণ নিয়েছিল। বছরের শেষদিকে আইএমএফ থেকে সরকারের কাছে চিঠি দেওয়া হয় দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ নিতে।ওই ঋণ নিতে হলে আগের ঋণ কোথায় কীভাবে খরচ করা হয়েছে, সেসব তথ্য দেওয়ার শর্ত আরোপ করা হয়। কিন্তু সরকার থেকে ওইসব তথ্য দেওয়া হয়নি।ফলে আইএমএফ দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ ছাড় করেনি। কেননা ওই সময় সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল নিরাপদ মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। যে কারণে ওই সময়ে আইএমএফ-এর ঋণ নিতে আগ্রহ দেখায়নি।শর্ত বাস্তবায়ন না করলে আইএমএফ যেমন ঋণ চুক্তি বাতিল করতে পারবে, তেমনই শর্ত বাস্তবায়নে বেশি চাপাচাপি করলে সরকারও ঋণ চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ রয়েছে।

এদিকে আইএমএফ-এর শর্তে রিজার্ভের নিট হিসাব নিরূপণ পদ্ধতি উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার।

গত বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ৩৪৩০ কোটি ডলার।এ থেকে বিভিন্ন তহবিলে বরাদ্দ ৮০০ কোটি ডলার বাদ দিলে নিট রিজার্ভ হবে। তবে তিনি নিট রিজার্ভের পরিমাণ উল্লেখ করেননি। এই প্রথম বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর একটি সংবাদ সম্মেলনে গ্রস রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন তহবিলে বরাদ্দ ৮০০ কোটি ডলার বাদ দিয়ে নিট রিজার্ভ হিসাব করার কথা বললেন।গভর্নরের তথ্য অনুযায়ী, গ্রস রিজার্ভ ৩৪৩০ কোটি ডলার থেকে ৮০০ কোটি ডলার বাদ দিলে নিট রিজার্ভ থাকছে ২৬৩০ কোটি ডলার। এর আগে আইএমএফ’র বিদায়ি মিশনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে প্রধান আলোচনার বিষয় ছিল রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন তহবিলে বরাদ্দ অর্থ বাদ দেওয়ার বিষয়টি।শুরুর দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে অনড় অবস্থায় থাকলেও পরে নমনীয় হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিট রিজার্ভ হিসাব করবে বলে জানায়, তবে প্রকাশ করতে আরও সময় চায়।

এদিকে বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রিজার্ভ গত বুধবার ছিল ৩৪২৬ কোটি ডলার। এতে গ্রস বা নিট কোনোটিই উল্লেখ করা হয়নি। তবে এটি হচ্ছে গ্রস রিজার্ভ। নিট হবে ২৬২৬ কোটি ডলার।

এই বিভাগের আরো খবর

Leave a Comment