জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর। ২৭৩ দিন চলে গেছে। কিন্তু দীর্ঘ এ সময়ে শীর্ষ ১৫ ঋণখেলাপির কাছ থেকে সোনালী ব্যাংক ১ টাকাও আদায় করতে পারেনি। এ ব্যর্থতার কারণে কোনো কর্মকর্তা কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হননি। কারও বেতন কমেনি, কেউ বোনাস বঞ্চিত হননি। বরং কেউ কেউ পদোন্নতি পেয়েছেন। আবার খুব স্বাভাবিকভাবেই অনেকে চাকরি জীবনের ইতি টেনেছেন। অফিসের কোনো কাজ থেমে নেই। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) গেছেন, এসেছেন। শুধু বড় খেলাপি ঋণের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটা শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব। পৃথিবীর কোথাও এমন নজির নেই। রাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ এবং সবল ব্যাংকের চিত্র এমন হলে ছোট ও দুর্বল ব্যাংকের অবস্থা কতটা খারাপ-তা সহজেই অনুমেয়।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ৯ মাসে শীর্ষ ১৫ ঋণখেলাপি থেকে ১ টাকাও আদায় না হওয়া খুবই দুঃখজনক। এতে করে ব্যাংকটি দুর্বল হয়ে যাবে। বিপুল অঙ্কের নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখতে হবে। ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা কমে যাবে। এসব খেলাপির কোনো জামানত থাকলে তা অবশ্যই বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বড় ঋণখেলাপিরা প্রভাবশালী। তাই তারা টাকা দিতে চান না। অথচ তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সবই চলছে। গুলশান, বনানী ও ধানমন্ডিতে আলিশান বাড়ি। চড়েন দামি গাড়িতে। ছেলেমেয়েদের বিদেশে লেখাপড়া করান। বিদেশ ভ্রমণ করেন বিজনেস ক্লাসে। শুধু ব্যাংকের টাকা দিতে পারেন না। তারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। টাকা আদায় করতে হলে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সব সম্পদ কেড়ে নিতে হবে। সব অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে হবে। এক কথায় কঠোর শাস্তি ছাড়া খেলাপি ঋণ আদায় হবে না। এছাড়া আইনের ফাঁকফোকর বন্ধ করতে হবে। তা না হলে আবার বেরিয়ে যাবে। একই সঙ্গে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। শীর্ষ ১৫ ঋণখেলাপি থেকে ৯ মাসে ১ টাকাও কেন আদায় হলো না। তাদের কোনো গাফিলতি ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে।
জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার মোহাম্মদ নুরুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, ৯ মাসে ১ টাকাও আদায় না হওয়ার লক্ষণ খুব বেশি ভালো নয়। খুঁজে দেখতে হবে, তারা ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত খেলাপি। ইচ্ছাকৃত খেলাপি হলে অবশ্যই তাদের কোনো রকম ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। অপর জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার মো. শফিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, সবকিছু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। তাদের উচিত ঋণ বিতরণের চেয়ে আদায়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করা।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আফজাল করিম যুগান্তরকে বলেন, শীর্ষ ২০ খেলাপি তো অনেক দিনের পুরোনো এবং একেবারে তলানিতে থাকা প্রতিষ্ঠান। টাকা আদায়ে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। তবুও প্রায় ৫০ লাখ টাকা আদায় হয়েছে। তবে অন্য খেলাপি থেকে আদায় বেশি হচ্ছে। আমি নতুন এসেছি। এসেই ১০০ দিনের বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করেছি। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
শীর্ষ ১৫ ঋণখেলাপি : প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছে আটকে ছিল ৪ হাজার ২৮৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০২২ সালে আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ১ হাজার ২৮৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। যা শীর্ষ ২০ খেলাপি ঋণের ৩০ শতাংশ। ইতোমধ্যে জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ৯ মাসে মাত্র পাঁচটি প্রতিষ্ঠান নামমাত্র ৪২ লাখ টাকা ফেরত দিয়েছে। বাকি ১৫টি প্রতিষ্ঠান ১ টাকাও ফেরত দেয়নি। এরমধ্যে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল করপোরেট শাখার গ্রাহক মেসার্স টি অ্যান্ড ব্রাদার্স গ্রুপের কাছে পাওনা ৪৯০ কোটি ২৭ লাখ টাকা। চলতি বছর আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১৪৭ কোটি ৮ লাখ টাকা। গ্রুপটি ১ টাকাও ফেরত দেয়নি। একই শাখার মেসার্স হলমার্ক গ্রুপের কাছে পাওনা ৪৮৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১৪৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। হলমার্কের কাছ থেকে একটা টাকাও আদায় হয়নি। এছাড়া রমনা করপোরেট শাখার গ্রাহক মেসার্স ফেয়ার অ্যান্ড ফেব্রিক্সের কাছে পাওনা ৩১৬ কোটি, স্থানীয় কার্যালয়ের গ্রাহক অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে পাওনা ৩০৪ কোটি, স্থানীয় কার্যালয়ের অপর গ্রাহক মেসার্স মেঘনা কনডেন্স মিল্কের কাছে পাওনা প্রায় ১৩১ কোটি, স্থানীয় কার্যালয়ের আরেক গ্রাহক ফারুক ডাইং নিটিং অ্যান্ড ম্যানু. লিমিটেডের কাছে পাওনা ৯০ কোটি, দিলকুশা করপোরেট শাখার গ্রাহক মেসার্স লীনা গ্রুপের কাছে পাওনা ২১৫ কোটি, দিলকুশা করপোরেট শাখার আরেক গ্রাহক মেসার্স সাইয়ান করপোরেশনের কাছে পাওনা ৭৬ কোটি টাকা, চট্টগ্রামের লালদীঘি করপোরেট শাখার গ্রাহক মডার্ন স্টিল মিলসের কাছে পাওনা ৪৪৭ কোটি ৮০ লাখ, লালদীঘি করপোরেট শাখার অপর গ্রাহক রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলসের কাছে পাওনা ১৮৪ কোটি, নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখার গ্রাহক মেসার্স রহমান গ্রুপের কাছে পাওনা ৩১৪ কোটি, খুলনা দৌলতপুর করপোরেট শাখার গ্রাহক মেসার্স একে জুট ট্রেডিংয়ের কাছে পাওনা ১১৭ কোটি, দৌলতপুর করপোরেট শাখার অপর গ্রাহক আব্দুর রাজ্জাক লিমিটেডের কাছে পাওনা প্রায় ১০৭ কোটি, একইভাবে দৌলতপুর করপোরেট শাখার আরেকজন গ্রাহক মেসার্স ইস্টার্ন ট্রেডার্সের কাছে পাওনা প্রায় ৯৩ কোটি এবং ফরিদপুর করপোরেট শাখার গ্রাহক মেসার্স সানবীম টেক্সটাইল মিলসের কাছে পাওনা ৮৬ কোটি টাকা। ৯ মাসে এসব শীর্ষ ঋণখেলাপি ১ টাকাও ফেরত দেয়নি।
previous post