প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে আবাদি জমি রক্ষায় পরিকল্পিত শিল্পায়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। একই সঙ্গে যুব ও নারীদের এই খাতে অবদান রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ব্যবসার ক্ষেত্র প্রস্তুত এবং সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল রবিবার সকালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সারা দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে (ইজেড) ৫০টি শিল্প ইউনিট, প্রকল্প ও সুযোগ-সুবিধা উদ্বোধনকালে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও ৫০টি শিল্প ইউনিট ও অবকাঠামোর উদ্বোধন এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে গিয়ে আজ আমি খুবই আনন্দিত। ’
বাসসের খবরে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কৃষি ও শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধিসহ আমাদের নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে।
জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন করে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে, যাতে নিজস্ব বাজার সৃষ্টি হয়। সরকার সে কারণেই সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে এবং প্রথমবার ক্ষমতায় এসেই বেশ কয়েকটি ইপিজেড নির্মাণ করেছে। ’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সারা দেশে এরই মধ্যে ইপিজেড করতে ৯৭টি জায়গা তাঁর সরকার ঠিক করে রেখেছে। সেখানে পর্যায়ক্রমে বিনিয়োগ আসবে। কভিড-১৯-এর অর্থনৈতিক ধাক্কা সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশে লাগলেও তাঁর সরকার সেটি সামলে নিয়ে অর্থনীতিকে গতিশীল রাখায় সচেষ্ট রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘এরপর মরার ওপর খাঁড়ার ঘা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং নিষেধাজ্ঞা-পাল্টা নিষেধাজ্ঞার ফলে আমাদের ক্রয়ক্ষমতায় সীমাবদ্ধতা নেমে এসেছে। আমদানি পণ্যের দাম এবং পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। ফলে অনেক দেশ মন্দায় ভুগছে। ’
শিল্প মালিকদের এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘নিজের কারখানা চালিয়ে অন্তত দেশের মানুষের চাহিদা পূরণের প্রচেষ্টা চালাবেন আপনারা। আওয়ামী লীগ সরকার আপনাদের অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। এখন আর হাওয়া ভবন নেই যে আপনাদের কোনো কাজ পেতে হলে সেখানে পাওনা ঘুচাতে অথবা এখানে-ওখানে ছোটাছুটি করতে হবে। আমরা দেশকে নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। ’ তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবেন। ব্যবসার ক্ষেত্র প্রস্তুত এবং সুযোগ-সুবিধা আমরা করে দিচ্ছি। আপনারা প্রত্যেকেই দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করবেন, যত বেশি মানুষের কল্যাণে কাজ করবেন, আমরা সরকার তত বেশি আপনাদের সহযোগিতা করব। কিন্তু এমন কিছু করবেন না, যাতে মানুষ কষ্ট পায় বা দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ’
বিশ্বব্যাপী খাদ্যাভাবের কারণে বাংলাদেশ উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মিরসরাই শিল্পাঞ্চলে যেসব ফসলি জমি রয়েছে সেগুলো ফসলি হবে। ’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে এবং এখান থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা আমরা নির্ধারণ করেছি। ’ তিনি বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো এরই মধ্যে ২৯টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক উৎপাদন করছে এবং ৬১টি শিল্প নির্মীয়মাণ রয়েছে। এ পর্যন্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রায় ৪৫ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এবং বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ছাড়া সব অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প নির্মাণে প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
শিল্পায়নের জন্য যা প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করার কথা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমাদের দেশে গ্যাস খুঁজে বের করার এবং বিদেশ থেকে ক্রয়ের চেষ্টা করছি, যাতে গ্যাস সংকটে না পড়তে হয়। ’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর
আমাদের মিরসরাই প্রতিনিধি জানান, চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের প্রান্ত থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, ভূমিমন্ত্রী সাইফুর রহমান চৌধুরী জাবেদ, মিরসরাইয়ের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, বসুন্ধরা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সাফওয়ান সোবহান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই শিল্পনগরের চারটি কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম এবং অবকাঠামো উন্নয়ন ভার্চুয়ালি উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান অর্থনৈতিক অঞ্চলে বাণিজ্যিক উৎপাদন উদ্বোধন এবং বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে বেজাকে অভিনন্দন জানান। এ সময় তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর অনেক দেশে নানা মডেলের অর্থনৈতিক অঞ্চল আছে। তবে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে ধরনের অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছেন, তাতে পৃথিবীর সব কটি মডেল যুক্ত রয়েছে। ’
এ সময় তিনি পূর্ববর্তী বক্তা বসুন্ধরা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সাফওয়ান সোবহানের বক্তব্যের রেশ টেনে বলেন, ‘আমার পূর্বে বসুন্ধরা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সাফওয়ান সোবহান যে কথা বলেছেন তার যথার্থ গুরুত্ব রয়েছে। কারণ আমরা যদি টেকসই শিল্পোন্নয়নের দিকে এগোতে চাই তাহলে দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে। তার জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ’
ভূমিমন্ত্রী সাইফুর রহমান চৌধুরী জাবেদ বলেন, ‘একটি দেশের অর্থনীতির উন্নতির জায়গা তৈরি করতে হলে অবশ্যই শিল্পায়নের প্রয়োজন রয়েছে। আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে ভিশন তা বাস্তবায়নের জন্য এটির গুরুত্ব অপরিসীম। ’
সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, কিছু লোক শিল্পজোনকে ঘিরে ফসলি জমি কেনা শুরু করেছে, যা কোনোভাবেই হতে দেওয়া যায় না। এরই মধ্যে আমি আমার এলাকার প্রশাসনের সহায়তায় অনেক ভূমিদস্যুকে ফসলি জমি থেকে উচ্ছেদ করেছি। আপনার কাছে অনুরোধ থাকবে, আপনি এ বিষয়ে একটি নির্দেশনা দেবেন। ’
বসুন্ধরা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সাফওয়ান সোবহান বলেন, ‘বাংলাদেশের যেসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে নানামুখী ইন্ডাস্ট্রি স্থাপন করা হচ্ছে, এটি অর্থনীতির জন্য অবশ্যই ইতিবাচক দিক। তবে এর জন্য দরকার দক্ষ জনশক্তি। ’ এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন, ‘এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে যারা কাজ করবে, তাদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। ’
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের চারটি শিল্প ছাড়াও অন্যান্য অর্থনৈতিক অঞ্চলের আরো ১০টি শিল্প ইউনিট বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ পিভিসি কারখানা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে চারটি কারখানার পাশাপাশি সিটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের দুটি, মেঘনা অর্থনৈতিক অঞ্চলের সাতটি এবং শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলের একটি শিল্প-কারখানা নিয়ে মোট ১৪টি কারখানার বাণিজ্যিক উৎপাদনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। অর্থনৈতিক অঞ্চলের সড়ক, ভবন, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোও উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে নির্মীয়মাণ ২৯টি কারখানার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন সরকারপ্রধান।
প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের প্রকল্প উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ভিডিও কনফারেন্সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর (বিএসএমএসএন মিরসরাই, চট্টগ্রাম), শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল (মৌলভীবাজার), কর্ণফুলী ড্রাইডক এসইজেড (আনোয়ারা, চট্টগ্রাম), মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্থনৈতিক অঞ্চল (সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ), জামালপুর অর্থনতিক অঞ্চল (জামালপুর সদর), সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক (সাবরাং, কক্সবাজার) ও হোসেন্দি অর্থনৈতিক অঞ্চল (গজারিয়া, মুন্সীগঞ্জ) থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সংযুক্ত হন।