ভারত থেকে আসামের স্পিকার বিশ্বজিৎ দাইমারি ৫৪ সদস্যের প্রতিনিধিদল নিয়ে ঢাকা সফর করে ফিরে গেলেন। এই প্রতিনিধিদলে ৩২ জন বিধায়ক ছিলেন। আসামের স্পিকার বাংলাদেশ থেকে ফিরে গিয়ে বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা দেবীর মতো। বাংলাদেশের উন্নতির জন্য হাসিনা কী কী করেছেন, সেসব দেখতেই এসেছিলেন এই প্রতিনিধিদল।
স্বাধীনতার পর দেশটা কিভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে মূলধন করে এগিয়েছে, সেসব দেখে-বুঝে ফিরেছেন দাইমারি তাঁর প্রতিনিধিদল নিয়ে। নানা কথার মধ্য দিয়ে তিনি বুঝিয়েছেন, ভৌগোলিক দিক থেকে যেমন এই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র এবং ভারতের অঙ্গরাজ্য আসাম কাছাকাছি, মনের দিক থেকেও ঠিক তেমনই কাছাকাছি। আলাদা শুধু সীমান্ত, আলাদা শুধু প্রশাসনের প্রশ্নে এবং আলাদা হতে পারে সার্বভৌমত্বে। দাইমারি নির্দ্বিধায় বলেছেন, তিনি বাংলাদেশের এই উন্নতির মডেল যা দেখে গেলেন, সেটি আসামে কিভাবে কাজে লাগানো যায়, সেটা নিষ্ঠাভরে করতে চান।
আসাম অঙ্গরাজ্যটি বিজেপি শাসিত। এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। এহেন শাসকদলের স্পিকার দাইমারি বাংলাদেশে গিয়ে একাধিক বৈঠক করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ফরেন সার্ভিসের অতিথিশালায় নৈশভোজ সেরে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের একটা নদী ব্রহ্মপুত্র, এক মাটি, এক আকাশ, এক আবহাওয়া। তিনি বাংলাদেশে থেকে চলে গেলেন, তাঁর এই যে ঐক্যের বাণী প্রচার, এটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানেন না—এমনটা কি হতে পারে? কখনোই নয়।
ভুলে গেলে চলবে না, নরেন্দ্র মোদি এমন একজন প্রধানমন্ত্রী, যিনি প্রতিটি ছোটখাটো বিষয়, এমনকি প্রতিটি বিদেশ সফর, তা সে মুখ্যমন্ত্রীরই হোক আর স্পিকারের হোক—সেসব তিনি তাঁর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মনিটর করেন। এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তিনি অনুপ্রবেশের ইস্যু নিয়ে প্রতিনিয়ত রাজনৈতিকভাবে সোচ্চার।
শাসকদল বিজেপি সম্প্রতি আবার নতুন করে জানিয়েছে, নাগরিকত্ব বিল প্রয়োগ করতে এই সরকার বদ্ধপরিকর এবং CAC কার্যকর হবেই। সেই রাজনৈতিক দল বিজেপি রয়েছে এখানকার রাজ্য সরকারে। কেন্দ্র সরকার স্পিকার দাইমারির সফরের বিষয়ে আগাম জানত না, এমনটা হতে পারে না। এই সফরটি এমন একটা সময় হয়েছে, যখন বাংলাদেশে নির্বাচন আসন্ন। ভারতে একের পর এক অঙ্গরাজ্যে ভোট হচ্ছে। ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচন। ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে ভারত জি২০-এর পৌরোহিত্য করার দায়িত্বপ্রাপ্ত। সেই জি২০-এর সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশকে বিশেষ আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। কাজেই দাইমারির এই বাংলাদেশ সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর কূটনৈতিকভাবেও এই সফর বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
আবার রাঙামাটি জেলায়, যেখানে অহমিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করে, স্পিকার সেখানেও সফর করতে গেছেন। ১৯ নভেম্বর সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া দিয়ে স্থলপথে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে তাঁর বাংলাদেশে প্রবেশও যথেষ্ট প্রতীকী তাৎপর্য বহন করে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তিনি বৈঠক করেছেন। তারপর সিনা পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে আগামী বছর জ্বালানি তেল আমদানি শুরু হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আসলে আগামী বছর এই প্রকল্পটি কার্যকর করতে দুই দেশই বদ্ধপরিকর।
গত রবিবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। সেখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রমুখ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আবার জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গেও ভারতের আসামের স্পিকারের দীর্ঘ আলোচনা হয়। সীমান্ত পথে, একটা ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন IBFBL গড়ে তোলা, বর্ডার হাট নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করাসহ অনেক বিষয় আলোচনায় উঠে এসেছে।
ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মা সম্প্রতি ঢাকায় এসেছেন। তিনি একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন। তার কারণ, এবারের সফরে রোহিঙ্গার বিষয়েও ভারতের যে কমিটমেন্ট, সে বিষয়টাও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয়েছে এবং ভারত বিষয়টাকে যে গুরুত্ব দিচ্ছে, সেটাও কিন্তু তাদের অবহিত করা হয়েছে। আসামের স্পিকারও বাংলাদেশ সফরে আসার আগে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করে এসছিলেন। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কাত্রাত মিয়ানমারে গেছেন। রাখাইনে, যেখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বিভিন্ন প্রকল্প নেয়া হয়েছে, সেখানে ভারত যোগ দিয়েছে। যৌথভাবে সেখানে এই সমস্যা মোকাবেলার চেষ্টা করা হচ্ছে।
কাজেই সব মিলিয়ে বলা যায়, এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে ভারত এবং বাংলাদেশের এই সম্পর্কের যে ঘাত-প্রতিঘাত, যেসব প্রতিকূলতা তৈরি হয়, সেগুলো অতিক্রম করে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের দিগন্ত বিস্তৃত করবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোয় নানা কারণে সমস্যা রয়েছে। আসামের সঙ্গে মেঘালয়ের সম্প্রতি কিছু বিষয়ে বিরোধ দেখা দিয়েছে। সেসব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কেননা ভারতীয় গোয়েন্দারা মনে করেন, চীন এবং পাকিস্তান যৌথভাবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অশান্তি তৈরি করতে তৎপর।
পাকিস্তানের সাবেক সেনাশাসক জিয়াউল হক তাঁর অপারেশন টোপাক-এর তত্ত্বে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে খণ্ড-বিখণ্ড করার জন্য একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। সেই অপারেশন টোপাক-১ ছিল কাশ্মীর আর অপারেশন টোপাক-২ ছিল উত্তর-পূর্বাঞ্চল। সেই ছায়াযুদ্ধের ধারাবাহিকতা আজও পাকিস্তান বহন করে চলেছে। সম্প্রতি পাকিস্তানের সেনাপ্রধান বদল হয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে কী সম্পর্ক দাঁড়াবে, কোথায় গিয়ে পৌঁছবে? কেননা SCO বৈঠকও আসছে। সেই বৈঠকে পাকিস্তান আমন্ত্রিত, চীন আমন্ত্রিত। সেখানে আবার ভারতই পৌরোহিত্য করছে সেই SCO বৈঠকে।
এখন এই পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে যাতে চিড় না ধরে, সেটা দেখাটা ভারতের দিক থেকেও একটা গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার। কেননা বিভিন্ন শত্রুপক্ষ তারা এই সম্পর্ককে বিনষ্ট করতে তৎপর। নানাভাবে, নানা দিক থেকে এই সম্পর্কটাকে যাতে অস্থির করে তোলা যায়, তার জন্য নানা ধরনের অপপ্রচার এবং নানা ধরনের অপচেষ্টা চলছে। এবারে আসামের স্পিকারের সফরের মধ্য দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আবার একটি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছেন।
এটা আরো স্পষ্ট হয়ে যায় যখন ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রাজকুমার রঞ্জন সিংহ বাংলাদেশে যান এবং জি২০ সম্মেলনের আগে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো এবং সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। আনুষ্ঠানিকভাবেও ভারত বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানাতে চলেছে। এই জি২০ সম্মেলনে বাংলাদেশের ভূমিকাটা কী হবে, না হবে—সেটারও একটা ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করা হচ্ছে। কাজেই এককথায় বলা যায়, সব কাঁটা পূর্ণ করে ফুটবে গো ফুল ফুটবে। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীকে এত সহজে বিনষ্ট করা কোনো শত্রুপক্ষের পক্ষেই সম্ভব হবে না।
ভারতের মতো এ রকম একটি বৃহৎ দেশে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পারস্পরিক ঐক্য বজায় রাখাটা খুব জরুরি। আসাম-মেঘালয় সীমানায় যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে, তা কাঙ্ক্ষিত নয়। আসামের কারবি আংলং-এর বন দপ্তরে একটি অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয় মেঘালয়ের একদল গ্রামবাসী। লাঠি-রড-কাস্তে হাতে এসেছিল মেঘালয়ের পশ্চিম জয়ন্তিয়া জেলার মোখড়ো গ্রামের একদল বাসিন্দা। কারবি আংলং-এর খেড়নি বনাঞ্চলের বিট অফিসে হামলা করে তারা। ভেঙে ফেলে সব আসবাব এবং বাইরে দাঁড় করানো মোটরবাইক, নষ্ট করে দেয় সব নথিপত্র। তারপর তারা বিট অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয়। পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে মেঘালয়ের পাঁচজন নাগরিক। এই পর্যটনের ভরা মৌসুমে আসাম সীমান্তের অশান্তি পর্যটকদের বিপদে ফেলেছে। তার ফলে ইন্টারনেট বন্ধ করতে হয়েছে, কারফিউ জারি হয়েছে। আসাম-মেঘালয় সড়কে যোগাযোগ বন্ধ, পণ্য পরিবহনে সমস্যা দেখা দিয়েছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বিবৃতি দিয়েছেন, পুলিশ গুলিটা না চালালেই ভালো হতো।
এখন এ রকম একটা পরিস্থিতিতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকেও ঐক্যবদ্ধ রাখা জরুরি এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে আসামের সম্পর্ক আরো মজবুত করা জরুরি, সেটা ভারত জানে। এই পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের ভূমিকা অত্যন্ত ইতিবাচক। ভারত সে ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। এই বোঝাপড়াটাকে নিয়েই কিন্তু সামনের দিনে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।