হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে ৫১ শতাংশ। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী বছর অক্টোবরে নতুন এই টার্মিনাল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের অন্যতম এই মেগাপ্রকল্পের কাজের অগ্রগতি প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। এটি নির্মাণ শেষ হলে শাহজালালের যাত্রীসেবার মান আমূল বদলে যাবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
বেবিচক সূত্র জানায়, থার্ড টার্মিনাল চালু হলে বিমানবন্দরের সক্ষমতা বাড়বে আড়াই গুণ। ফলে তিনটি টার্মিনাল দিয়ে বছরে শাহজালালের যাত্রী পারাপারের সক্ষমতা ৮০ লাখ থেকে বেড়ে দুই কোটি ২০ লাখে দাঁড়াবে।
দেশের প্রধান বিমানবন্দর শাহজালালে বর্তমানে দুটি টার্মিনাল রয়েছে। এই দুটি টার্মিনাল এক লাখ বর্গমিটার জায়গার ওপর। তৃতীয় যে টার্মিনালটি হচ্ছে, সেটি বর্তমান দুটি টার্মিনালের দ্বিগুণের বেশি। দুই লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার এলাকা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয় এই থার্ড টার্মিনাল নির্মাণকাজ। পরিকল্পনা অনুসারে, এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ২০২৪ সালের এপ্রিলের মধ্যে। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে প্রায় ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে এই থার্ড টার্মিনাল নির্মাণে।
এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে জাপানের মিত্সুবিশি ও ফুজিটা এবং কোরিয়ার স্যামসাং এই তিনটি প্রতিষ্ঠান থার্ড টার্মিনাল ভবন নির্মাণকাজ করছে। থার্ড টার্মিনালের নকশা করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্থপতি রোহানি বাহারিন, যিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনালের নকশা করে বিশ্বে খ্যাতি কুড়িয়েছেন।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, থার্ড টার্মিনালে মোট ৩৭টি অ্যাপ্রোন পার্কিং থাকবে। অর্থাৎ একসঙ্গে ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্ক করা যাবে। শাহজালাল বিমানবন্দরে বর্তমানে চারটি ট্যাক্সিওয়ে আছে। নতুন করে আরো দুটি হাই স্পিড ট্যাক্সিওয়ে যোগ হচ্ছে। রানওয়েতে উড়োজাহাজকে যাতে বেশি সময় থাকতে না হয়, সে জন্য নতুন দুটি ট্যাক্সিওয়ে তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়া পণ্য আমদানি ও রপ্তানির জন্য দুটি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। আরো থাকবে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য তিনতলা ভবন।
বেবিচকের তথ্যানুযায়ী, থার্ড টার্মিনালে থাকবে ২৬টি বোর্ডিং ব্রিজ। প্রথম ধাপে চালু করা হবে ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ। থাকবে উড়োজাহাজ রাখার জন্য ৩৬টি পার্কিং বে। বহির্গমনের জন্য ১৫টি সেলফ সার্ভিস চেকইন কাউন্টারসহ মোট ১১৫টি চেকইন কাউন্টার থাকবে। এ ছাড়া ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট কন্ট্রোল কাউন্টারসহ থাকবে ৬৬টি ডিপারচার ইমিগ্রেশন কাউন্টার। আগমনের ক্ষেত্রে পাঁচটি স্বয়ংক্রিয় চেকইন কাউন্টারসহ মোট ৫৯টি পাসপোর্ট ও ১৯টি চেকইন অ্যারাইভাল কাউন্টার থাকবে। এর বাইরে টার্মিনালে ১৬টি আগমনী ব্যাগেজ বেল্ট স্থাপন করা হবে। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য থার্ড টার্মিনালের সঙ্গে মাল্টিলেভেল কার পার্কিং ভবন নির্মাণ করা হবে। এতে এক হাজার ৩৫০টি গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে।
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগামী বছর অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই টার্মিনাল উদ্বোধন করবেন। আগামী এক বছরে কাজের গতি আরো বাড়বে। এখন অবকাঠামো কাজের শেষে যেসব যন্ত্রপাতি প্রয়োজন, সেগুলো স্থাপন করা হবে। ’
সূত্র জানায়, থার্ড টার্মিনাল ভবনের সঙ্গে ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গপথ ও উড়ালসেতু নির্মাণ করা হবে, যার মাধ্যমে মেট্রো রেল ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগব্যবস্থা থাকবে। এতে থাকবে আন্তর্জাতিক মানের অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা। থার্ড টার্মিনালে স্বতন্ত্র কোনো ভিভিআইপি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে না। তবে টার্মিনাল ভবনের ভেতর দক্ষিণ পাশে সর্বাধুনিক সুবিধাসম্পন্ন ভিভিআইপিদের সময় কাটানোর জায়গা থাকবে।
এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান আরো বলেন, ‘সরকারের স্বপ্নের প্রকল্প থার্ড টার্মিনালের নির্মাণকাজ শেষ হলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে এবং ভবিষ্যতে আরো অনেক দেশের বিমান সংস্থার উড়োজাহাজের এ দেশের বিমানবন্দর দিয়ে চলাচলের সুযোগ সৃষ্টি হবে। বেবিচকের আয় বাড়বে এবং আকাশপথে যাত্রীদের আরো সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হবে। ’
বেবিচকের সাবেক চেয়ারম্যান এয়ার কমোডর (অব.) এম ইকবাল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে এয়ারপোর্টের আধুনিকায়নে খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। তবে নতুন থার্ড টার্মিনাল হলে কিছুটা কাটিয়ে ওঠা যাবে; কিন্তু এটি না হওয়া পর্যন্ত যে হারে যাত্রী বাড়বে, তা সামাল দিতে এখন থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য আরো নতুন বিমানবন্দর স্থাপনের উদ্যোগ দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। ’
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বলেছেন, ‘বিদ্যমান অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা দূর হওয়ায় যাত্রীরা এই বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক মানের সেবা পাবে। থার্ড টার্মিনালের প্রকল্প ব্যয় কোনোভাবেই বাড়বে না। বরং মোট প্রকল্প ব্যয় থেকে ৭৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। এই টাকা দিয়ে সরকার ও জাইকার সম্মতি এবং অন্যান্য বিধিগত প্রক্রিয়া নিষ্পত্তি সাপেক্ষে থার্ড টার্মিনালে নির্মিতব্য ১২টি বোর্ডিং ব্রিজের অতিরিক্ত আরো ১৪টি বোর্ডিং ব্রিজ এবং একটি ভিভিআইপি টার্মিনাল কমপ্লেক্স নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়ে আমরা আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করার কথা ভাবছি। যারা এই টেন্ডারে উত্তীর্ণ হবে তারাই কাজ পাবে। ’
kalerkantho