করোনায় গত বছর ২২ ডিসেম্বর হারিয়েছিল বাবাকে। এরপর মা-ই ছিল তার অবলম্বন। বাবার মতো মা-ও চলে গেলেন সেই ডিসেম্বর মাসেই। তার আর কিছুই রইল না।
ডিসেম্বর মাসটা এখন ওর কাছে ভয়ংকর মাস হয়ে উঠেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রাইভেট কারের নিচে প্রাণ হারানো রুবিনা আক্তারের ১৪ বছরের ছেলে আরাফাত রহমান রোহানকে পাশে নিয়ে গতকাল শনিবার দুপুরে এভাবে বিলাপ করছিলেন দূর সম্পর্কের নানা মির্জা রুহুল আমীন। তেজগাঁওয়ের তেজকুনিপাড়ার হোন্ডা গলিতে রোহানদের বাসায় কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘রোহান আমার দূর সম্পর্কের নাতি। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ছুটে এসেছি। মায়ের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে ছেলেটা শোকে পাথর হয়ে গেছে। কান্নাও করতে পারছে না। কখনো স্থির হয়ে বসে থাকে, কখনো পায়চারি করে। ’
ওই সময় দেখা গেল, ডাইনিংটেবিলে স্থির হয়ে বসে রয়েছে রোহান। খালা, ফুফুরা তাকে ঘিরে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে সে কারো সঙ্গে কথা বলছিল না।
পাশে থাকা ফুফু আফরোজা সুলতানা ডলি বলেন, ‘মায়ের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে কিছুই আর খায়নি রোহান। কারো সঙ্গে কথাও বলছে না। বাসার পাশেই স্কুলের এক শিক্ষিকার কাছে প্রাইভেট পড়ে, সেখানেও যেতে রাজি নয়। ’
রোহানের খালা রোকসানা আক্তার বলেন, ‘রোহান তেজগাঁও ক্যাথলিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। গত বছর করোনায় তার বাবা মাহবুবুর রহমান ডলারের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে তেজগাঁওয়ের হোন্ডা গলিতে স্বামীর বাড়িতেই থাকতেন রুবিনা। বাড়িভাড়া ও স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া সহযোগিতায় ছেলেকে নিয়ে কেটে যাচ্ছিল তাঁর। স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলেকে কখনো বাবার অভাব বুঝতে দেননি। কিন্তু এখন ছেলেটার কী হবে? মায়ের অভাব তো আর কিছু দিয়ে পূরণ করা যাবে না!’
রুবিনা আক্তারের ভাই জাকির হোসেন জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর রুবিনা বিভিন্ন প্রয়োজনে হাজারীবাগে বাবার বাসায় ছুটে আসতেন। গত শুক্রবারও হাজারীবাগে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। কিন্তু জীবিত আর যেতে পারলেন না। তিনি জানান, ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল শনিবার বিকেলে রুবিনার লাশ প্রথমে স্বামীর বাড়ি তেজগাঁওয়ে নেওয়া হয়। সেখান থেকে হাজারীবাগে বাবার বাড়িতে নিয়ে বাদ মাগরিব জানাজা শেষে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
পুলিশ হেফাজতে চিকিৎসাধীন সেই চালক শিক্ষক
রুবিনাকে প্রাইভেট কারের নিচে ফেলে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া চালক আজহার জাফর শাহ পুলিশ হেফাজতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন। পথচারীদের মারধরে তাঁর মাথা ও চোখে গুরুতর জখম হয়েছে। এ ছাড়া তাঁর শরীরজুড়ে রয়েছে আঘাতের চিহ্ন।
হাসপাতালে আজহার জাফরকে দেখভাল করছেন মোছা. মনি নামের এক নারী। গতকাল দুপুরে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘স্যার গুলশান ১ নম্বরে থাকেন। তাঁর পরিবারে কেউ নেই। তিনি একাই থাকেন। আমি উনার বাসায় আট বছর ধরে কাজ করি। এই আট বছরে বাসায় উনার স্ত্রী-সন্তান বা আত্মীয়-স্বজন কাউকে আসতে দেখিনি। শুক্রবার রাতে আমি স্যারের এক বন্ধুর মাধ্যমে ঘটনা জানতে পারি। তারপর শাহবাগ থানায় এলে স্যারের সঙ্গে দেখা হয়। ’
আজহার জাফর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। ২০১৮ সালে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়। বর্তমানে তিনি পুলিশ পাহারায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
শাহবাগ থানার এএসআই অনুপম জানান, শুক্রবার গভীর রাতে নিহত রুবিনা আক্তারের ভাই জাকির হোসেন সড়ক পরিবহন আইনে আজহার জাফর শাহকে আসামি করে মামলা করেছেন।
প্রাইভেট কারে এখনো রক্তের দাগ
রুবিনা আক্তারকে চাপা দেওয়া সেই গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-০৫-০০৫৫) জব্দ করে শাহবাগ থানায় রাখা হয়েছে। গতকাল বিকেলে থানায় গিয়ে দেখা যায়, ওই গাড়িতে তখনো রক্তের দাগ লেগে আছে। গাড়ির দরজা-জানালা, হেডলাইট সব কিছু ভাঙা।
নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে শিক্ষার্থীদের সমাবেশ
আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষকের গাড়িচাপায় রুবিনা আক্তারের মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে ঢাবিতে গতকাল সকালে বহিরাগত যান চলাচল বন্ধের দাবিতে সমাবেশ করেছে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের ঢাবি শাখা। সমাবেশে সংগঠনটির ঢাবি শাখার সভাপতি রিফাত জাহান শাওন বলেন, ‘আমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয় যেন পার্কে পরিণত না হয়, বহিরাগত যান যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে চলাচল না করে—বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। এ ঘটনার যেন আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেই ব্যবস্থা নিতেও প্রশাসনের কাছে আমরা আবেদন জানাচ্ছি। ’
এদিকে শুক্রবার রাতে তিন দফা দাবিতে ঢাবি উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা আন্দোলনকারীরা গতকাল বিকেলেও উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। তাঁদের দাবিগুলো হলো ঢাবির রাস্তা সিটি করপোরেশনের অধীন থেকে ঢাবি কর্তৃপক্ষের আওতায় আনতে হবে, বাইরের যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, অভ্যন্তরীণ যানবাহনের ক্ষেত্রে গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ এবং ক্যাম্পাসের প্রতিটি প্রবেশমুখে চেকপোস্ট বসাতে হবে।
এ বিষয়ে ঢাবি প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা তাদের কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে এসেছিল। তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তাদের যে দাবিদাওয়া সেগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। সবাই সহযোগিতা করলে নিরাপদ ক্যাম্পাস বাস্তবায়ন করা যাবে। ’