যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক শোলে গতকাল বুধবার ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনসহ সরকার ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। গতকালই তিনি ঢাকা ছেড়ে যান। এসব বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকটসহ মিয়ানমার পরিস্থিতি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।
ডেরেক শোলের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকায় আসে। গতকাল সকালে তিনি পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে প্রাতরাশ বৈঠক করেন।
সংসদ নির্বাচন হবে অবাধ ও নিরপেক্ষ : ডেরেক শোলে গতকাল সকালে গণভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন। আগামী নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। আমি সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছি।’
বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আগামী সাধারণ নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে তাঁর দল দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। তিনি কখনোই ভোট কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে চান না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন এবং এর প্রশাসনিক ও আর্থিক স্বাধীনতা রয়েছে। প্রথমবারের মতো সংসদে ইসির পুনর্গঠন আইন পাস হয় এবং সেই আইনের ভিত্তিতে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়।
সামাজিক, অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকারের আমলে গত ১৪ বছরে বাংলাদেশের এই পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়েছে। অব্যাহত গণতান্ত্রিক চর্চা ও স্থিতিশীলতার কারণেই এমনটা সম্ভব হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বোঝা হিসেবে দেখা দিয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দাদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে এবং মিয়ানমার থেকে বিপুলসংখ্যক নাগরিক আসার কারণে স্থানীয়রা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। তিনি আরো বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা মাদকপাচার, মানবপাচার, সন্ত্রাসবাদ ও আন্তঃসহিংসতার মতো নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস যা বলল : ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস জানায়, বৈঠকগুলোতে কাউন্সেলর শোলে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অব্যাহত রাখার আশ্বাস দেন। পাশাপাশি তিনি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং মানবাধিকার সুরক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি প্রশমনে সহযোগিতা এবং একটি উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল গড়ে তোলার ওপরও তিনি জোর দেন।
সফর শেষে ডেরেক শোলে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তির পরপরই আমি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে এসেছি। এ জন্য আমি সম্মানিত বোধ করছি।’ তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে শক্তিশালী অংশীদারি আছে। কয়েক দশকের সহযোগিতা ও সমর্থনের ভিত্তিতে এটি গড়ে উঠেছে। আমরা বাণিজ্য, বিনিয়োগ, নিরাপত্তা ও যৌথ অগ্রাধিকারের অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের সম্পর্ক জোরদার করার অপেক্ষায় রয়েছি।’
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস জানায়, যুক্তরাষ্ট্র সরকার আমাদের উভয় দেশের জন্য আরো বেশি স্থিতিশীল, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে চায়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যা বলল : ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ডেরেক শোলের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের বৈঠকে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে বিশেষ করে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি এবং ইউক্রেন সংকট প্রাধান্য পায়। কাউন্সেলর শোলে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি এ জনগোষ্ঠীর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার আশ্বাস দেন। যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের চলমান বিচারিক প্রক্রিয়ায় সমর্থন এবং সম্ভাব্য সহায়তার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে।
যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, আলোচনায় রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং অবিলম্বে যুদ্ধের সমাপ্তির পক্ষে বাংলাদেশ তার জোরালো অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে। পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য অবরোধের জেরে বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট খাদ্য ও জ্বালানি সংকট এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির ফলে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ। এটি নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহবান জানিয়েছে।
খাদ্যসংকট সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন ডেরেক শোলে। এ ছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত নিরসনে গৃহীত আন্তর্জাতিক উদ্যোগে বাংলাদেশের সমর্থনও চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
র্যাবের কার্যক্রমে ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রশংসা : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, মার্কিন প্রতিনিধিদল র্যাবের কার্যক্রমের ইতিবাচক পরিবর্তনের বিষয়ে সাধুবাদ জানিয়েছে। এর পাশাপাশি র্যাবের কার্যক্রমের টেকসই সংস্কারের ওপরও গুরুত্বারোপ করে।
র্যাবকে একটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও কার্যকর আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ সংস্থা এরই মধ্যে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে সক্ষম হয়েছে। এ সময় তিনি র্যাবের দক্ষতা বৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা ও সহায়তা কামনা করেন। বৈঠকে গনমাধ্যমের স্বাধীনতা, জাতীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয় বলে জানানো হয়।
অভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা : দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠকের পর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক শোলে বলেছেন, সফরকালে তিনি দুই দেশের অভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। রাজনৈতিক, নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে দুই দেশের অংশীদারি বাড়ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা সম্পর্কের পরবর্তী ৫০ বছরের বিষয়ে আশাবাদী।’
যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানান ডেরেক শোলে। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যার মূল উৎস মিয়ানমারে। আমরা এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করে যাব।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনও বলেছেন, ‘আমরা সম্পর্ককে আরো উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই। বাংলাদেশে ১০০টি নতুন বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। সেখানে তারা (যুক্তরাষ্ট্র) বিনিয়োগ করলে খুশি হব।’
সম্পাদকদের সঙ্গে আলোচনা : এদিকে ডেরেক শোলে গতকাল বিকেলে ঢাকায় আমেরিকান সেন্টারে গণমাধ্যম সম্পাদকদের সঙ্গে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশসহ বিশ্বের যেকোনো দেশে গণতন্ত্রের অবক্ষয় হলে সে দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা করার ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে বলে মন্তব্য করেছেন শোলে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের জোরালো অংশীদারি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে। যেখানে গণতন্ত্র দুর্বল হয় হচ্ছে সেখানে সহযোগিতা সীমিত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে, প্রভাব পড়ছে ব্যবসা ও বিনিয়োগে।
ডেরেক শোলে বলেন, মার্কিন কম্পানিগুলো কোনো দেশে বিনিয়োগ করার সময় সেখানে স্বচ্ছতা, আইনের শাসন ও জবাবদিহি চায়।
বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে কী হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে শোলে বলেন, তিনি এ বিষয়ে কিছু অনুমান করতে চান না। তবে তিনি বিশ্বাস করেন, এ দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। সরকারও বলেছে, তারা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চায়।