প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। অতীতের খাদ্য ঘাটতির বাংলাদেশ আজ খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত হয়েছে। আজ ‘বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট’এর সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব উপলক্ষ্যে গতকাল বুধবার দেয়া এক বাণীতে তিনি এ কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কৃষির উন্নয়ন ও কৃষকের কল্যাণে নির্বাচনি ইশতেহার ২০১৮, জাতীয় কৃষি নীতি-২০১৮ এবং অন্যান্য পরিকল্পনা দলিলের আলোকে সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।’ তিনি বলেন, ‘গত পাঁচ দশকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, ক্রমহ্রাসমান কৃষি জমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সৃষ্ট নানাবিধ বৈরী পরিবেশ মোকাবিলা করেও দেশের খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ। এরই অংশ হিসেবে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। অতীতের খাদ্য ঘাটতির বাংলাদেশ আজ খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ইতোমধ্যে ৮টি হাইব্রিডসহ মোট ১১১টি উচ্চফলনশীল ধানের জাত ও তিন শতাধিক ধান উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। উদ্ভাবিত জাতগুলোর মধ্যে বন্যা, খরা, জলমগ্নতা, লবণাক্ততা, ঠান্ডা ইত্যাদি প্রতিকূলতা সহিষ্ণু, রোগ প্রতিরোধী, প্রিমিয়াম কোয়ালিটি, জিঙ্ক, আয়রন ও পুষ্টি-সমৃদ্ধ ধানের জাত উল্লেখযোগ্য।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ÔRice Vision-2050Õ এবং ÔDoubling Rice Productivity by 2030Õ শীর্ষক দু’টি কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছে। এই কৌশলপত্র আমাদের সরকারের দূরদর্শী নীতি যেমন- অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট ২০৩০, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা-২০৪১ এবং ডেল্টা পরিকল্পনা ২১০০ বাস্তবায়নের জন্য ‘রোড ম্যাপ’ হিসেবে কাজ করবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রযুক্তিগত দিক থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কোন অংশেই পিছিয়ে নেই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। ফলে শুরু হয় ধানের ওপর আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর পর দেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সবুজ বিপ্লবের ডাক দেন। তাঁরই ডাকে সাড়া দিয়ে ব্রি’র বিজ্ঞানীরা স্বল্প সময়ের মধ্যেই উদ্ভাবন করেন নতুন জাতের ধান বিআর-৩ বা বিপ্লব, যা দেশের খাদ্য উৎপাদনে সত্যিই বিপ্লব নিয়ে আসে। জাতির পিতার নির্দেশিত পথ ধরেই গত পাঁচ দশকে এদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করে বলেছেন, সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের সাথে সাথে প্রতিষ্ঠানটি আগামী দিনে ধান গবেষণার ক্ষেত্রে নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরো বেশি সচেষ্ট হবে এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে টেকসই করার মাধ্যমে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ তথা জাতির পিতার আজীবন স্বপ্নের ‘সোনার বাংলাদেশ’ গড়ে তুলতে আরো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
বাণীতে তিনি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)-এর গৌরব ও সাফল্যের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞানী, কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানান এবং ইনস্টিটিউটের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের সার্বিক সাফল্য কামনা করেন।
এদিকে সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে ১১১টিরও বেশি আধুনিক ধানের জাত উন্নয়নসহ ৫০ বছরের উদ্ভাবন সাফল্য তুলে ধরার মাধ্যমে আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্যাম্পাসে স্বাগত জানানোর সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)।
গতকাল এখানে ব্রি’র কর্মকর্তাগণ জানান, দেশের কৃষি খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ব্রি দিবসটি উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ দু’দিনের বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেবেন এবং তিনি গাজীপুরে ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিদর্শন করবেন।
এই উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
সফরকালে প্রধানমন্ত্রী আজ সকাল ১১ টা ২৫ মিনিটে ব্রি’তে ‘বঙ্গবন্ধু-পিয়েরে এলিয়ট ট্রুডো কৃষি প্রযুক্তি কেন্দ্র’ উদ্বোধন করবেন।
টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল ইনস্টিটিউট ফর ফুড সিকিউরিটি এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন অংশীদারিত্বে সহযোগিতার লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) অনুসারে ব্রি’তে প্রযুক্তি কেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়েছে। ।
পরে, প্রধানমন্ত্রী ব্রি’র গত ৫০ বছরে গর্ব ও সাফল্যের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে বেলুন ও পায়রা উড়াবেন।
প্রধানমন্ত্রী বৃক্ষরোপণ, ব্রি ল্যাবরোটরিজ পরিদর্শন, ব্রি’র বিভিন্ন উদ্ভাবনসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেবেন এবং ‘ধান কাব্য’ শীর্ষক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন।
প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে ‘ব্রি’র গর্ব ও সাফল্যের ৫০ বছর’ শীর্ষক একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হবে।
সকাল ১১টায় ব্রি হেলিপ্যাডে পৌঁছার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।
ব্রি-এর ৫০ বছরের সাফল্যের তাৎপর্য নিয়ে বাসসের সঙ্গে আলাপকালে ব্রি মহাপরিচালক ড. এম শাহজাহান কবির বলেন, “বাংলাদেশ এক সময় ছিল দীর্ঘস্থায়ী খাদ্য ঘাটতির দেশ, কিন্তু এখন ধান বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়েছে।”
স্বাধীনতা অর্জন আমাদের মহান সাফল্য এবং একই সাথে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনও আমাদের আরেকটি যুগান্তকারী সাফল্যের বিষয় উল্লেখ করে ডিজি বলেন, ‘এখন আমরা ২০৫০ সাল পর্যন্ত একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছি, যাতে দেশে আর কখনই খাদ্য ঘাটতি না হয়।’
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক, কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার, গ্লোবাল ইনস্টিটিউট অফ ফুড সিকিউরিটি (জিআইএফএস), কানাডার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও নির্বাহী পরিচালক স্টিভেন ওয়েব, আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইআরআরআই), ফিলিপাইনের মহাপরিচালক জিন বালফে, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ মোহাম্মদ বকতিয়ার এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. এম শাহজাহান কবিরসহ অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আগামীকালের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন।
ব্রি এ পর্যন্ত ১১১টি ধানের আধুনিক জাত উদ্ভাবন ও অবমুক্ত করেছে, ১০৪টি ইনব্রিড ও ৭টি হাইব্রিড। এর মধ্যে ২৪টি বিভিন্ন সহিষ্ণু জাত, যার ১০টি লবণাক্ত সহিষ্ণু, তিনটি নিমজ্জন সহিষ্ণু, তিনটি খরা সহিষ্ণু, চারটি শীত সহিষ্ণু, দু’টি জলোচ্ছ্বাস সহিষ্ণু, একটি আধা-গভীর জল এবং একটি দ্বৈত সহিষ্ণু (সাল+সাব)।
এছাড়াও, ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ১৩টি প্রিমিয়াম মানের, পাঁচটি জেডএন-সমৃদ্ধ এবং তিনটি নিম্ন জিআই (গ্লাইসেমিক ইনডেক্স) ধান তৈরি করা হয়েছে। জানা গেছে, দেশের মোট ধানি জমির ৮০ শতাংশেরও বেশি ব্রি ধানের উৎপাদন করা হয়েছে এবং জাতীয় ধান উৎপাদনে এর অবদান প্রায় ৯১ শতাংশ।
স্বাধীনতার পর থেকে জনসংখ্যা আড়াই গুণ বাড়লেও ধানের উৎপাদন সাড়ে তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন কৃষিবান্ধব সরকারের দৃঢ় সমর্থনের কারণে ধান বিজ্ঞানী, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী এবং কৃষকদের সাফল্যের গল্প ফুটে উঠেছে।
বাংলাদেশ ২০১৩ সালে চাল রপ্তানি শুরু করে এবং এই অসাধারণ অর্জনের পিছনে মূল অবদান রয়েছে যে প্রতিষ্ঠানের সেটি হল বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)।