নিউজ ডেস্ক ৷৷ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় ক্বাত্রা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি তার দেশের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গণভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে তিনি বলেন, ‘আপনার এবং আপনার নেতৃত্বের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।’ বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার মো. নজরুল ইসলাম এ তথ্য জানান। বিনয় ক্বাত্রা বলেন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিসহ উন্নয়ন যাত্রায় ভারত বাংলাদেশের পাশে থাকবে।
বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শেখ হাসিনাকে চলতি বছরের ৯-১০ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠেয় গ্রুপ অব টুয়েন্টি (জি-২০) শীর্ষ সম্মেলনের ১৮তম আসরে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। প্রধানমন্ত্রী আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানান। ১ ডিসেম্বর, ২০২২ থেকে ৩০ নভেম্বর, ২০২৩ পর্যন্ত জি-২০’র সভাপতির দায়িত্বে থাকা ভারত গ্রুপটির সব বৈঠকে বাংলাদেশকে ‘অতিথি দেশ’ হিসাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বন্ধন অত্যন্ত দৃঢ় বর্ণনা করে বিনয় ক্বাত্রা বলেন, সমগ্র বিশ্ব এখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে মূল্যায়ন করে, যা ইতোমধ্যেই কৌশলগত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই সম্পর্ক আরও মজবুত হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী ভারতকে বিশ্বস্ত বন্ধু উল্লেখ করেন এবং এই বন্ধুত্ব আরও গভীর হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, দুই প্রতিবেশীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে উভয় দেশই কাজ করতে পারে।
সফররত ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বলেন, তারা ইন্ডিয়ান লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) শর্তাবলি সহজ করার চেষ্টা করছেন, যাতে বাংলাদেশ সহজেই ঋণ নিতে এবং তা পরিশোধ করতে পারে। তিনি বলেন, দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা-বাণিজ্য দুই দেশের স্থানীয় মুদ্রা ব্যবহার করেই পরিচালনা করা যেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব এম তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা উপস্থিত ছিলেন।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় ক্বাত্রা দুদিনের সফরে বুধবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশে এসেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
সচিব পর্যায়ে আলোচনার পর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তার শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন এবং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি গত সেপ্টেম্বরে ভারতে তার রাষ্ট্রীয় সফরের কথা সন্তোষ চিত্তে স্মরণ করেন এবং বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় বন্ধুত্বপূর্ণ এবং কৌশলগত সম্পর্ক অধিকতর উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। পরবর্তীতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব প্রধানমন্ত্রী বরাবর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা বার্তা পৌঁছে দেন। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। বৈঠক সম্পর্কে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী এবং গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুরাষ্ট্র। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালে সহায়তা ও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সহযোগিতা এ বন্ধুত্বকে বিশেষমাত্রা দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার এ বৃহত্তম দেশ ভারত অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই প্রভূত সাফল্য অর্জন করেছে। উভয় প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান চমৎকার সম্পর্কের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে।
সচিব বলেন, দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। আমরা বলেছি বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটবর্তী ও গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু হিসাবে ভারতের কাছে আমরা দুদেশের মধ্যে বিদ্যমান সব অনিষ্পন্ন বিষয়গুলোর আশু নিষ্পত্তির নিমিত্ত ভারতের সহযোগিতা কামনা করি এবং এই লক্ষ্যে আমরা একযোগে কাজ করতে গুরুত্ব আরোপ করি। আমি তিস্তাসহ সব আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ে দ্রুত চুক্তি সম্পাদনের গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করি এবং এ সমাধানের জন্য ভারতের নিবিড় সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছি। সেই সঙ্গে গত সেপ্টেম্বরে ভারতে প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় সফরের সময়ে স্বাক্ষরিত কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন বিষয়ে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য ভারতের পররাষ্ট্র সচিবকে অনুরোধ জানিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে সীমান্ত হত্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে, তবে আমরা এটিকে শূন্যে নামিয়ে আনতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এই লক্ষ্যে ভারত সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। তা ছাড়া আন্তঃসীমান্ত অপরাধ, মাদক পাচারসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কার্যক্রম নির্মূলে আমাদের চলমান প্রচেষ্টা জোরদার করতে সম্মত হয়েছি।
তিনি বলেন, ভারত আমাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। ভারতের সাথে আমাদের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য বিদ্যমান ট্যারিফ, প্যারা-ট্যারিফের মতো বাধাগুলো দূর করার ওপর আমরা গুরুত্ব আরোপ করেছি। আমরা ভারত থেকে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেছি। ভারতের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে রেল ও সড়ক যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে আমাদের চলমান প্রচেষ্টা এবং কার্যক্রম বেগবান করতে আমরা একমত হয়েছি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বর্তমানে ভারতের সঙ্গে জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ খাতে আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা ভারত হতে বর্তমানে প্রায় ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছি। ভারত হতে আমাদের বিদ্যুৎ আমদানি আগামী দিনে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে আশা করছি। চলমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং বিশেষ করে বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহের ওপর আমি গুরুত্ব আরোপ করেছি। ভারত হতে জ্বালানি আমদানি করতে বাংলাদেশ এবং ভারতের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত ‘বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইনের উদ্বোধনের বিষয়ে আলোচনা করেছি। ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আনার বিষয়েও আমি ভারতের সহযোগিতা কামনা করেছি। তিনি বলেন, এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় এবং রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশে অবস্থানরত ১.১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে ভারতের দ্রুত ও সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে আহ্বান জানিয়েছি। তিনি বলেন, প্রতি বছর পর্যটন এবং চিকিৎসা উপলক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি ভারত সফর করে। তাদের ভিসা প্রাপ্তি সহজীকরণের জন্য আমরা অনুরোধ জানিয়েছি। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণ নেতৃত্বে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসহ সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভুতপূর্ব উন্নয়নের ভূয়সী প্রসংশা করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে জি-২০ শীর্ষক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণ এবং উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ একটি রোল মডেল হিসাবে তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেছেন যে বাংলাদেশ ভারতের প্রতিবেশী প্রথম নীতির আওতায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার লাভ করে। তিনি বাংলাদেশকে ভারতের বিশ্বস্ত বন্ধু, এই অঞ্চলের সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার হিসাবে উল্লেখ করে সব বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে ভারত সরকারের গভীর আগ্রহ এবং প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের সব দ্বিপক্ষীয় বিষয় যেমন পানি-বণ্টন, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য, কানেক্টিভিটি, দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসহ সব ইস্যুতে ভারতের সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে ভারত সরকারের চলমান প্রচেষ্টা জোরদার করা হবে মর্মে তিনি উল্লেখ করেন এবং এই লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে ঐকমত্য প্রকাশ করেন।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব আজ ভারতের উদ্দেশে বাংলাদেশ ত্যাগ করবেন।