প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ এখন হৃদরোগের চিকিৎসায় প্রায় স্বাবলম্বী উল্লেখ করে বলেছেন, তার সরকার স্বাস্থ্যসেবাকে আরও সাশ্রয়ী করেছে এবং এটিকে প্রতিটি দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি হৃদরোগের চিকিৎসায় বাংলাদেশকে প্রায় স্বনির্ভর করে তুলেছে। হৃদরোগের ৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশ চিকিৎসার সক্ষমতা রয়েছে এবং এ লক্ষ্যে দেশে দক্ষ জনশক্তি, আধুনিক প্রযুক্তি এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি রয়েছে।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে ‘বাংলাদেশ কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ আয়োজিত তৃতীয় বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে প্রচারিত পূর্বে-রেকর্ডকৃত এক ভিডিও বার্তায় প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, বৈজ্ঞানিক কমিটির উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ এবং ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি কোর্সের চেয়ারম্যান ডা. রাজেশ এম ডেভ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। বাংলাদেশ কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতি বছর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে ১৭ দশমিক ৯ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে বলেন, সারা বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলো হৃদরোগ। বাংলাদেশে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার প্রায় ২৭ শতাংশ এবং যেখানে প্রতি হাজারে ১০ জন শিশু হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং প্রতি পাঁচ যুবকের মধ্যে একজন হৃদরোগের ঝুঁকিতে রয়েছে।
সরকার প্রধান বলেন, খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক ব্যায়ামের অভাব, ধূমপান এবং ডায়াবেটিসের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। হৃদরোগীদের চিকিৎসা সুবিধা উন্নত করার পাশাপাশি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ওপর আমাদের নজর দিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা এখন সফলভাবে হৃদরোগের চিকিৎসা দিচ্ছেন যার সুফল জনগণ পাচ্ছে এবং এর ফলে দেশের বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসার জন্য একটি সম্পূর্ণ কার্ডিয়াক ইউনিট স্থাপনের কাজ চলছে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) একটি সম্পূর্ণ কার্ডিওলজি ও কার্ডিয়াক সার্জারি ইউনিট নির্মাণের মাধ্যমে আরও দক্ষ হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ তৈরির সুযোগ রয়েছে। বিএসএমএমইউতে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট একটি বিশ্বমানের কার্ডিওভাসকুলার অব সায়েন্স অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের স্বাস্থ্য খাতের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, যার ভিত্তিতে বর্তমানে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চলছে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক মানের বিশেষজ্ঞ তৈরির জন্য স্নাতকোত্তর পর্যায়ে চিকিৎসকদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য আইপিজিএমআর এবং বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান অ্যান্ড সার্জন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমাদের সরকার ১৯৯৬-২০০১ সময়কালে আইপিজিএমআরকে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে রূপান্তরিত করেছে।
স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক উন্নয়নে তার সরকারের পদক্ষেপের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও গত ১৪ বছরে স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এ পর্যন্ত ১১টি স্নাতকোত্তর ‘সুপার বিশেষায়িত হাসপাতাল’, কার্ডিওভাসকুলার হাসপাতাল, বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, ক্যান্সার হাসপাতাল, নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল এবং অন্যান্য হাসপাতাল স্থাপনের পাশাপাশি সারা দেশে ৬০০টিরও বেশি হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, গ্রামের মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে আমরা ১৮ হাজার ৫০০টি কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছি। হাসপাতাল থেকে ত্রিশ প্রকার ওষুধ বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। সারাদেশে ৪৩টি হাসপাতালে টেলি-মেডিসিন সেবা চালু করা হয়েছে, যেখানে মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ৩০ হাজার স্যাটেলাইট ক্লিনিক রয়েছে। এ ছাড়া পাঁচ লাখ অটিস্টিক শিশুকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ১০৩টি সেবা কেন্দ্র রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) আমাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বাংলাদেশকে পোলিও ও ধনুষ্টঙ্কার (টিটেনাস) মুক্ত দেশ ঘোষণা করেছে। তার সরকার প্রতিটি জেলায় একটি করে মেডিক্যাল কলেজ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে। তিনি বলেন, মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা এখন ২০০৯ সালের ৫০টি থেকে ১১৫টিতে দাঁড়িয়েছে এবং মেডিক্যাল কলেজে আসন সংখ্যা এখন ১০ হাজার ৭৮৯-এ দাঁড়িয়েছে, যা ২০০৯ সালে ছিল শুধু ২ হাজার ৫০টি।
শেখ হাসিনা বলেন, ডেন্টাল মেডিক্যাল কলেজ ও ইউনিটের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৭টি, যা ২০০৯ সালে ছিল মাত্র ১৩টি। তার সরকার প্রতিটি বিভাগে একটি করে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করবে এবং ইতোমধ্যে চারটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া তার সরকার গত তিন বছরে ১০ হাজার চিকিৎসক এবং পনের হাজার নার্স ও মিডওয়াইফ নিয়োগ দিয়েছে।
সরকার প্রধান বলেন, আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে উন্নত হয়েছে এবং চিকিৎসকদের দক্ষতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে যেসব রোগের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে হতো সেসব রোগের চিকিৎসা এখন দেশেই হচ্ছে। বিভিন্ন জটিল রোগ যেমন কিডনি, লিভার, বাইপাস, নিউরো সার্জারি এবং বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট এখন বাংলাদেশে সফলভাবে চিকিৎসা হচ্ছে।