কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। অর্থনীতি ঠিক রা"/>
Home Lead 2 কঠিন চাপে দেশ ॥ পররাষ্ট্র নীতিতে ভারসাম্য

কঠিন চাপে দেশ ॥ পররাষ্ট্র নীতিতে ভারসাম্য

কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব

by Nahid Himel

কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। অর্থনীতি ঠিক রাখতে বহির্বিশ্বের সঙ্গে ভারসাম্যের রাজনীতি বজায় রেখে কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখত বাংলাদেশ। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বাংলাদেশের এই নীতিকে কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলেছে। যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো এখন দু’ভাগে বিভক্ত। বাংলাদেশ এখন  পর্যন্ত ভারতের মতো ভারসাম্যের নীতি বজায় রেখে চলেছে। সে কারণে জাতিসংঘের রাশিয়ার ওপর নেওয়া নিষেধাজ্ঞা এবং নিন্দা প্রস্তাবে কখনো ভেটো দিচ্ছে বা কখনো ভোটদানে বিরত থাকছে আবার কখনো পক্ষে ভোট দিচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাচ্ছে।

একদিকে ইউক্রেনের পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব  এবং অন্যদিকে রাশিয়ার পক্ষে চীন, ইরান, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়ার মতো রাষ্ট্রগুলো অবস্থান নিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ভোটদানে বিরত থাকার মতো ভারসাম্যের নীতি গ্রহণ করলেও এখন এই নীতিতে অটল থাকা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়েছে।
গত বুধ ও বৃহস্পতিবারে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জি-২০ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরাও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে একমত হতে পারেননি।  কোনো যৌথ ঘোষণা ছাড়াই ওই সম্মেলন শেষ হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। তিনিও যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন।
জি-২০ সম্মেলনের ফাঁকে ১০ মিনিটের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এবং রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের মধ্যে। সেখানে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেন, যতদিন প্রয়োজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে সহায়তা অব্যাহত রাখবে। তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি ল্যাভরভ। এসব কারণে দুই মন্ত্রীর বৈঠক খুব বেশি এগোয়নি। এক প্রকার তিক্ততার মধ্যেই তা শেষ হয়। জি-২০ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার নিঃশর্তভাবে সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে যৌথ বিবৃতি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু রাশিয়ার আপত্তিতে চীন সমর্থন জানানোয় তা আলোর মুখ দেখেনি। ফলে সম্মেলন থেকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধে ইতিবাচক কোনো ফল আসেনি। উল্টো বহির্বিশ্ব যে স্পষ্টত দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে সেটিই প্রতীয়মান হয়েছে।
পরাশক্তিদের ভূ-রাজনীতি, কৌশলগত ও প্রভাব বলয় সৃষ্টির প্রতিযোগিতা প্রতিদিনই বাড়ছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের পর দুই বলয়ের এই স্নায়ুযুদ্ধের প্রভাব পড়েছে গোটা বিশ্বে। এসব শক্তির মধ্যে সম্পর্কের ভারসাম্য  বজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে নিরপেক্ষ বলয়ে থাকা দেশগুলো। কারণ, এখন দিন যতই যাচ্ছে আস্তে আস্তে সবাই জড়িয়ে পড়ছে নানা হিসাব-নিকাশে। দুই বলয়ের মতভেদের কারণে এক ধরনের চাপে পড়েছে বাংলাদেশ।
জো বাইডেন প্রশাসন বর্তমানে এশিয়ার মিত্র দেশগুলোকে নিয়ে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ (আইপিএস) গঠন করেছে। সেখানে তারা বাংলাদেশকেও চাচ্ছে। তবে চীন চাচ্ছে এই জোটে বাংলাদেশ যেন না যোগ দেয়। আইপিএসের আওতায় সামরিক সহযোগিতা জোরদারে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারত এই চার দেশের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে কোয়াড। তবে কোয়াডের অন্যতম সদস্য জাপানের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক জোরদারের পরিকল্পনা বাংলাদেশের রয়েছে।
ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদারে যাত্রা শুরু করেছে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফোরাম’ (আইপিইএফ)। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এসব জোটের লক্ষ্য হলো, চীনের  বিরুদ্ধে একটি বলয় গঠন করা। সেখানে ভারত ও বাংলাদেশের অংশগ্রহণ কামনা করছে দেশটি। এটি নিয়ে বর্তমানে প্রচ্ছন্ন চাপও দিচ্ছে দেশটি।
সম্প্রতি বাংলাদেশে দেশটির কর্মকর্তাদের সফর বেড়েছে। প্রতিটি সফরেই দেশটির কর্মকর্তারা আইপিএসে বাংলাদেশ যোগ দিলে কিভাবে লাভবান হবে সেটির ব্যাখ্যা দিচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ কোনো জোটে যোগ দেয়নি। তবে অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাইডেনের আইপিইএসের কোনো কোনো উপাদানে যোগ দেওয়া যায় কিনা খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত সমুদ্রসীমার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোয়াড জোটে যোগ দিলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে নিজেদের স্বার্থের বাইরে যাচ্ছে না। বিশেষ করে কোয়াডের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথ নজরদারি করছে।  একসঙ্গে নজরদারি করলেও তাইওয়ান, মিয়ানমার প্রভৃতি ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। এর পরও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক জোট আইপিইএফে যোগ দিয়েছে ভারত। বাংলাদেশকেও আইপিইএফে যোগদানে উৎসাহ দিচ্ছে প্রতিবেশী দেশটি। তবে বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র চীনও মার্কিন জোটে যোগ দেওয়া বা না দেওয়ার ওপর কড়া নজর রাখছে।
আইপিএসে অংশগ্রহণের পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রস্তাবেও বাংলাদেশকে নিজেদের পক্ষে চাচ্ছে বাইডেন প্রশাসন। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ভারতের মতো অবস্থান বজায় রাখছে এই ইস্যুতে। কখনো পক্ষে ভোট দিচ্ছে আবার কখনো বিপক্ষে ভোট দিচ্ছে। তবে বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে  ভারতের মতো ব্যবসায়িক সম্পর্ক রাখেনি। ভারত নানা সমালোচনার পরও রাশিয়া থেকে কম দামে নিজেদের অর্থনীতির স্বার্থে তেল আমদানি অব্যাহত রেখেছে। কম দামে তেল কিনে তারা লাভবানও হয়েছে।
বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এতটা সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। আবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে কড়া বার্তা এখনো দেয়নি। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মেনে রাশিয়ার জাহাজকে বাংলাদেশে ভিড়তে দেয়নি বাংলাদেশ। যার কারণে বাংলাদেশের  রাষ্ট্রদূতকে ডেকে রাশিয়া সমালোচনা করেছে।  পাশাপাশি বাংলাদেশও রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতকে ডেকে বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূতকে তলবের ব্যাখ্যা চেয়েছে।
স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র ছাড়াও বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধকালীন রাশিয়ার সহায়তার বিষয়টি মাথায় রাখছে। কারণ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের আগেও রাশিয়া নানা ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সম্পর্কও মধুর। সেই কারণে বাংলাদেশ পশ্চিমা বিশ্বের চোখ রাঙানির পরও একেবারে রাশিয়াকে ছেড়ে যায়নি।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে। আগের মতো মার্কিন কর্মকর্তারা বাংলাদেশ সফরকালে গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ নানা ইস্যুতে সমালোচনা কমিয়েছেন। সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সিলর ডেরেক শোলে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানান। পাশাপাশি মার্কিন কর্মকর্তারা এও বলছেন যে, তারা কোনো দলের পক্ষে নন। তারা নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলে থাকেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠককালে রাজনীতি, নির্বাচন, মানবাধিকার প্রভৃতি বিষয়ে বৈঠকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পক্ষে সোচ্চার হলেও প্রকাশ্যে মন্তব্যে শোলে সতর্ক ছিলেন। এবারের সফরে ডেরেক শোলে প্রকাশ্য কিংবা রুদ্ধদ্বার বৈঠকে কোথাও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলেননি। তিনি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলেছেন।
২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি নেতারা বিভিন্ন মহলে মন্তব্য করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে উৎসাহ দিয়ে পরে তাদের পক্ষে থাকেনি। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের কানে যাওয়ার পর এবার তারা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা মুখে আনছে না। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা কোনো দলের পক্ষে নয়। একইদিনে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ভিনয় ক্বাত্রা ঢাকা সফরকালে মন্তব্য করেন যে, ভারত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে থাকবে। তাই বাংলাদেশের বিভিন্ন জোটে যোগদান এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে অবস্থান দেশটির চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশকে পাশে পেতে যুক্তরাষ্ট্র বোঝানোর পাশাপাশি প্রচ্ছন্ন চাপও দিচ্ছে। র‌্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর দেশটি এখন পোশাক শিল্পের কপিরাইট নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এছাড়া জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় ২৮ শতাংশ অর্থায়ন যুক্তরাষ্ট্রের। মানবাধিকার, গণতন্ত্রসহ অন্যান্য বিষয় সামনে আনার পাশাপাশি দেশটির কর্মকর্তারা    চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তথাপি বাংলাদেশের সরকার সতর্কভাবে পা ফেলছে ভবিষ্যতের বিষয়ে। কারণ, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সামরিক নয় শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে জোটে যাওয়া না যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছে।

এই বিভাগের আরো খবর

Leave a Comment