জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের এমপি আইনি ধকল কাটিয়ে উঠে রাজনীতির মাঠে পুরোমাত্রায় সক্রিয় হয়েছেন ।পার্টির চেয়ারম্যান হয়েও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না-আদলতের এমন নির্দেশনা তাঁকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
তিনি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের শতভাগ সাফল্য অর্জনে সব ধরনের প্রস্তুতি শুরু করেছেন । বড় দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নিজেদের একক ক্ষমতা ও শক্তির ওপরই ভরসা আপাতত জিএম কাদেরের। সেই অনুযায়ী নির্বাচনি রোডম্যাপও তৈরি করছেন তিনি।
জিএম কাদের বনানীতে পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয় রজনীগন্ধায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পার্টির কো-চেয়ারম্যান, প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সংসদ-সদস্যদের যৌথ সভায় বিষয়টি স্পষ্ট করেই বলেছেন। মূলত আইনি ঝামেলা থেকে উত্তরণের পর তাঁর সভাপতিত্বে এটাই ছিল জাতীয় পার্টির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের সভা।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ, প্রার্থী বাছাই, সাংগঠনিক প্রস্তুতি, জেলা-উপজেলা এবং কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আয়োজনসহ নানান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় এই বৈঠকে। আলোচনা হয় দলটির আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনা নিয়েও।
এ প্রসঙ্গে জিএম কাদের বলেন, আমরা আপাতত আগামী নির্বাচনকেই গুরুত্ব দিচ্ছি। জাতীয় পার্টি সব সময় নির্বাচনমুখী একটি রাজনৈতিক দল। তাই নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো বিকল্প আমাদের হাতে নেই।
তিনি আরও বলেন, জাতীয় পার্টি এই মুহূর্তে এককভাবেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এজন্য ৩০০ আসনেই প্রার্থী ঠিক করতে কাজ শুরু করেছি। ইতোমধ্যে বেশকিছু আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী চূড়ান্ত করে তাদের নির্বাচনি প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে।
ন। তিন মাসেরও বেশি সময় আইনি লড়াই শেষে দলীয় কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর এখন অনেকটাই নির্ভার জিএম কাদের। পার্টির চেয়ারম্যান হিসাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করতে না পারায় দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে যে ক্ষোভ এবং হতাশা নেমে এসেছিল, তাও এখন আর নেই।
এদিকে দায়িত্ব পালনের বাঁধা কাটার পর প্রথম দিনই গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন জিএম কাদের। পার্টিকে নির্বাচনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত করা-লক্ষ্য বলে জানান তিনি।
এরপর ধারাবাহিকভাবে জাতীয় পার্টি ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ, জাতীয় মহিলা পার্টি, জাতীয় সাংস্কৃতিক পার্টি, জাতীয় কৃষক পার্টি, জাতীয় শ্রমিক পার্টি, জাতীয় যুবসংহতি, জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক পার্টি, জাতীয় ছাত্রসমাজ, জাতীয় ওলামা পার্টি, জাতীয় মৎস্যজীবী পার্টিসহ বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করেন জিএম কাদের। সবশেষে দলের কো-চেয়ারম্যান, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ-সদস্যদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন তিনি।
জানা যায়, প্রতিটি বৈঠকেই দলের নেতাকর্মীদের আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেন। যেসব সাংগঠনিক জেলা ও উপজেলায় সম্মেলন হয়নি, সেগুলো দ্রুত শেষ করতে বলেন। সময় ও সুযোগমতো পার্টির কেন্দ্রীয় সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান তিনি।
এ বৈঠকে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের ছেলে রাহগীর আল মাহি (সাদ এরশাদ) এমপি উপস্থিত থাকায় দলটির অভ্যন্তরে অনৈক্য নিয়ে যে আলোচনা চলছিল, তাও কার্যত ফিকে হয়ে যায়। এর মধ্য দিয়ে মনে করা হচ্ছে, জাতীয় পার্টি এখন অনেকটাই একাট্টা।
জাতীয় পার্টির একাধিক সূত্র জানায়, দলের কো-চেয়ারম্যান, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ-সদস্যদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে জিএম কাদের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেন। আপাতত বড় দলের সঙ্গে জোট গঠনের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য শীর্ষ নেতাদের প্রস্তুতি নিতে বলেন। একই সঙ্গে বর্তমান সংসদ-সদস্য এবং আগামী দিনে যারা দলের মনোনয়নে নির্বাচন করবেন, তাদের এলাকামুখী হতেও নির্দেশ দেন। রোজা ও ঈদের সময় সাধারণ মানুষের পাশে থাকার জন্য পরামর্শ দেন জিএম কাদের। এছাড়াও প্রতিটি বিভাগে একটি করে বড় ধরনের সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত হয় এ সময়।
বৈঠকে জিএম কাদের বলেন, আগামী নির্বাচন জাতীয় পার্টির জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের জন্য, এমনকি নির্বাচন কমিশনের জন্যও এই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা বড় চ্যালেঞ্জ। হাতে যেহেতু সময় একদম কম, তাই বসে না থেকে এখন থেকেই পুরোদমে নির্বাচনি প্রস্তুতি শুরু করতে হবে।
নির্বাচনের আগে বড় কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোটে যাওয়া সম্পর্কে তিনি এ সময় বলেন, এটি সময় ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে। তখন দলীয় ফোরামে আলাপ-আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
জিএম কাদের নিজেও সম্প্রতি রংপুর এবং নীলফামারী জেলা ঘুরে আসেন। ইতোমধ্যে জেলা-উপজেলায় পার্টির সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তুতি নেয়া শুরু হয়েছে। এরই অংশ হিসাবে খুলনা জেলা ও খুলনা মহানগর, জামালপুর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গায় সম্মেলন সম্প্রতি সম্পন্ন হয়েছে।
। ১৫ মার্চ রাঙামাটি জেলা জাতীয় পার্টির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এবং মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ সিনিয়র নেতারা সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এমপি বলেন, জাতীয় পার্টি একটি নির্বাচনমুখী দল। এই মুহূর্তে নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। কেউ চাচ্ছেন সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে, আবার কেউ চাচ্ছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। আমরা জাতীয় পার্টি প্রথম থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিশ্বাস করি না। আমরা মনে করি, নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্য যদি ভালো থাকে এবং সরকার যদি চায়, তাহলেই সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হবে। নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্যও হবে।
তিনি আরও বলেন, জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনেই নির্বাচন করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে নির্বাচনের আগে পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখে তখন আমরা কী করব, তা সবাই বসে ঠিক করব।
মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, একটি মামলার কারণে পার্টির চেয়ারম্যান অনেকদিন ধরে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারেননি। এখন তিনি স্বাধীন ও মুক্ত। তাই তার নেতৃত্বে দল গোছানো, দলকে শক্তিশালী করা, যোগ্য প্রার্থী বাছাই করা এবং পার্টিকে নির্বাচনমুখী করাই আমাদের এখন মূল লক্ষ্য।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৪ অক্টোবর জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত নেতা এবং দলটির সাবেক সংসদ-সদস্য অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা পার্টির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে মামলা করেন। বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৩০ অক্টোবর ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসাবে জিএম কাদেরের দলীয় কোনো প্রকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেন। পরে এই আদেশ খারিজ চেয়ে আবেদন করেন তিনি। সেটিও খারিজ হয়ে যায়।
এই আদেশ চ্যালেঞ্জ করে গত বছরের ২৩ নভেম্বর ঢাকার জেলা জজ আদালতে আপিল আবেদন করেন জিএম কাদের। কিন্তু আবেদন নামঞ্জুর করেন জেলা জজ আদালত। পরে বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতে যান তিনি। ৫ ফেব্রুয়ারি শুনানি শেষে নিু আদালতের আদেশ স্থগিত করেন হাইকোর্ট। এর ফলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসাবে জিএম কাদেরের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আইনি বাধা কেটে যায়।