ইংলিশদের বাংলাওয়াশ করে ইতিহাস গড়েছে সাকিব বাহিনী। প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ৬ উইকেটে জেতার পর দ্বিতীয় ম্যাচে ৪ উইকেটে জিতে সিরিজ নিশ্চিত করে হাথুরুসিংহের শিষ্যরা। আজ ১৪ মার্চ মঙ্গলবার তৃতীয় তথা শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ইংল্যান্ডকে ১৬ রানে হারিয়ে বাটলার বাহিনীকে বাংলাওয়াশ করে বিশ্বকে চমকে দিয়েছে টাইগাররা।
ছবি: সংগৃহীত
হোম অব ক্রিকেট মিরপুরে টস জিতে আগে বলিং করার সিদ্ধান্ত নেন ইংলিশ অধিনায়ক জস বাটলার। টাইগাররা আগে ব্যাট করতে নেমে নির্ধারতি ২০ ওভারে ২ উইকেটে হারিয়ে ১৫৮ রান করে। ৫৭ বলে ৭৩ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন লিটন। ৩৬ বলে অনবদ্য ৪৭ রান করেন ইনফর্ম নাজমুল হোসেন শান্ত। বাংলাদেশকে দারুন সূচনা এনে দেন দুই ওপেনার লিটন দাস ও রনি তালুকদার। পাওয়ার প্লে-তে কোন উইকেট না হারিয়ে ৪৬ রান তোলে লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা।
দলীয় ৫৫ রানে ২২ বলে ২৪ রান করে সাজঘরে ফেরেন রনি। এরপর ক্রিজে লিটনের সঙ্গী হন শান্ত। ১০টি চার ও ১টি ছক্কায় ৫৭ বলে ৭৩ রান করেন লিটন। এরপর আর কোন উইকেট হারায়নি টাইগাররা। সাকিব আল হাসানের সঙ্গে শেষ ১৮ বলে ১৯ রান যোগ করেন শান্ত। ফলে ১৫৮ রানের সংগ্রহ পায় বাংলাদেশ। ১টি চার ও ২টি ছক্কায় ৩৬ বলে অপরাজিত ৪৭ রান করেন শান্ত। ৬ বলে ৪ রান নিয়ে অপরাজিত থাকেন সাকজবাবে ব্যাট করতে নেমে প্রথম বলে চার মেরে শুরু করেন ইংলিশ ওপেনার ডেভিড মালান। তবে প্রথম ওভারেই এক বল পরই তানভীরের শিকার ফিল সল্ট। এরপর মালান আউট হন ৪৭ বলে ৫৩ রান করে। এর পরের বলেই আউট হন আউট বাটলার। মোস্তাফিজের লেংথ বলটা পয়েন্টে খেলে সিঙ্গেল নিতে গিয়েছিলেন বেন ডাকেট, সাড়াও দিয়েছিলেন বাটলার। তবে মিরাজের থ্রো সরাসরি স্টাম্পে আঘাত হানে। এরপর ডাকেটের ১১, মঈন আলির ৯, স্যাম কারানের ৪ রানে বেশিদূর এগুতে পারেনি ইংলিশরা। গুটিয়ে যান মাত্র ১৪২ রানে। টাইগাররা জয় পায় ১৬ রানে। ফলে ৩-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতে নেয় সাকিব বাহিনি। প্রথম সিরিজেই ইংলিশদের হোয়াইটওয়াশ করে টাইগাররা।
মিরাজ যেন এক জাদুকর
এ কী ভানুমতি, এ কী ইন্দ্রজাল…।’ সৈয়দ মুজতবা আলীর রসগোল্লা গল্পটা পড়া থাকলে, মিরপুরে মেহেদী হাসান মিরাজের ঘূর্ণিবলে বেসামাল ইংলিশরা হয়তো এটাই বলে উঠতেন! আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অর্ধযুগ পেরিয়েও যার বোলিং টি২০’র সঙ্গে যায় কি না- এমন সন্দেহ যাদের, তাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করলেন সময়ের অন্যতম সফল এ অলরাউন্ডার। সিরিজে টিকে থাকতে জিততেই হবে, এমন ম্যাচে ১১৭ রানে অলআউট ছোট্ট দুই ফরম্যাটের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। যেখানে মিরাজের বোলিং ফিগার ৪-০-১২-৪। একে একে সাজঘরে ফিরিয়েছেন মঈন আলি, স্যাম কুরান, ক্রিস ওকস ও ক্রিস জর্ডানকে।
একটিও চার কিংবা ছক্কা হজম করতে হয়নি! ডট বল ১৩টি। ২০১৭ থেকে ২০তম টি২০তে ২৫ বছর বয়সী ডানহাতি অফস্পিনারের এটি ক্যারিয়ারসেরা বোলিং। আগের সেরা ছিল ৩ ওভারে ১৭ রান দিয়ে ৩ উইকেট, গত বছর সেপ্টেম্বরে, দুবাইয়ে স্বাগতিক আরব আমিরাতের বিপক্ষে। জাদুকরী বোলিংয়ের পর ব্যাট হাতে অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে ২ ছক্কায় ২০ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলে টি২০’র ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঐতিহাসিক প্রথম সিরিজজয়ের দিনে ম্যাচসেরাও হয়েছেন মিরাজ। অষ্টম ওভারে ৫৫ রানের মধ্যে সাজ অধিনায়ক বাটলারসহ টপঅর্ডারের তিন ব্যাটসম্যান।

.
মঈনের সঙ্গী হন বেন ডাকেট। দুই বাঁহাতিকে ক্রিজে দেখে পরের ওভারেই মিরাজকে বোলিংয়ে আনতে দেরি করেননি বিচক্ষণ অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। লেগ সাইডে সীমানার ওপর দুজন ফিল্ডার থাকলেও স্লগ করেন ১৭ বলে ১৫ রান করা মঈন, ক্যাচ যায় ডিপ মিডউইকেটে হাসান মাহমুদের কাছে। আগের ৫ বলে এসেছিল মাত্র দুটি সিঙ্গেল, সে চাপ কমাতে গিয়ে নিজেই ফাঁদে পড়েন মঈন। ১৫তম ওভারে জোড়া আঘাত হানেন মিরাজ। কুরান এবং ওকসকে ফিরিয়ে ইংলিশদের বড় সংগ্রহের স্বপ্ন ধুলায় মিশিয়ে দেন ডানহাতি অফস্পিনার। ওভারের দ্বিতীয় বলে বেরিয়ে এসে খেলতে চেয়েছিলেন কুরান। তাকে এগোতে দেখে মিরাজ বল করেন অফ স্টাম্পের বেশ বাইরে, সেটি ব্যাটে খেলতে পারেননি ব্যাটসম্যান। স্টাম্পিংয়ে বাকি কাজ সারেন উইকেটরক্ষক লিটন দাস। ভাঙেন ৩২ বল স্থায়ী ৩৪ রানের জুটি। ১৬ বলে কুরান করেন ১২ রান। এক বল পর আরেক উইকেট। অনেকটা এগিয়ে গিয়ে খেলতে গিয়ে রানের খাতা খোলার আগেই স্টাম্পড ওকস। দ্বিতীয় চেষ্টায় বল গ্লাভসে জমিয়ে বেলস ফেলে দেন লিটন। সিরিজে প্রথমবার সুযোগ পাওয়া মিরাজের চতুর্থ শিকার ক্রিস জর্ডান। দলের ১৭তম ও তার ৪ ওভারের কোটার শেষ বলে ছক্কার চেষ্টায় ডিপ মিডউইকেটে রনি তালুকদারের হাতে ধরা পড়েন ৩ রান করা ইংলিশ অলরাউন্ডার। ২০তম টি২০তে এসে ইনিংসে প্রথম ৪ উইকেটের স্বাদ পান মিরাজ। আগের ১৯ ম্যাচে ছিল ৮ উইকেট। সেটি এখন ১২।
৪ ওভারে মাত্র ১২ রান দিয়ে শিকার ৪ উইকেট। টি২০তে বাংলাদেশের হয়ে এর চেয়ে ভালো বোলিং ফিগার আছে আর ৯টি। ১৩ রানে ৫ উইকেট নিয়ে শীর্ষে ইলিয়াস সানি, বেলফাস্টে ২০১২ সালে, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। টি২০তে ৫ উইকেট আছে আর সাকিব, মোসাদ্দেক হোসেন ও মুস্তাফিজুর রহমানের। মিরপুরের স্লো উইকেটে বাংলাদেশও অবশ্য অল্প টার্গেটে বিপাকে পড়ে। পাঁচ নম্বরে নেমে বেশ চাপের মুখেও ১৬ বলে ২ ছক্কায় ২০ রানের কার্যকর এক ইনিংস খেলেন মিরাজ। তার ওই দুই ছক্কাই পরে তাসকিন আহমেদের (৩ বলে অপরাজিত ৮) মতো টেল-এন্ডারের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে দেয়। দুটি চারে খেল খতম করে ৪ উইকেটের অবিস্মরণীয় জয় এনে দেন তিনি। বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো ম্যাচের পর ঐতিহাসিক সিরিজয়ের আনন্দে মেতে ওঠে টাইগাররা।
ম্যাচসেরা লিটন
৫৭ বলে ৭৩ রানের নান্দনিক ইনিংস এবং দুর্দান্ত কিপিংয়ের সুবাদে ম্যাচসেরার পুরস্কার জেতেন লিটন কুমার দাস ছবি: ভোরের কাগজ
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিপক্ষীয় সিরিজের প্রতি ম্যাচেই ব্যাট হাতে দলকে ভালো কিছু দেয়ার চেষ্টা করেন। তবে প্রথম ম্যাচ থেকেই ব্যর্থ হতে হয় এই টপ অর্ডার ব্যাটারকে। ইংলিশ বধের মিশনে তামিম ইকবারের সঙ্গে ওপেন করতে নেমে তিনি ১৫ বলে একটি ছয়সহ ৭ রান করে সাজঘরে ফিরে যান। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওয়ানডে ম্যাচে তিনি রানের খাতাই খুলতে পারেননি। টি- টোয়েন্টি সিরিজ থেকে তিনি নিজের ছন্দে ফেরার ইঙ্গিত দেন। যদিও ভালো কোনো সংগ্রহ তার ব্যাট থেকে আসেনি সেই ম্যাচে।
তবে তার আগ্রাসী শুরুটাই ছিল বাংলাদেশের জয়ের মন্ত্র। দ্বিতীয় ম্যাচেও লিটনের একই রূপ দেখে ভক্তরা। সিরিজের তৃতীয় ও মিশন হোয়াইটওয়াশের ম্যাচে তার ছন্দহীনতার কারণে ভালো কিছু আশা করেনি কেউই। তবে ইংলিশ বোলারদের কোণঠাসা করে স্বরূপে ফিরে আসেন লিটন। টস হেরে বাংলাদেশের হয়ে রনি তালুকদারের সঙ্গে জুটি বেঁধে পিচে আসেন তিনি। শুরু থেকেই প্রথম দুই ম্যাচের মতো আগ্রাসী ব্যাটিং দিয়েই ম্যাচ শুরু করেন এই ব্যাটার। একপাশে ব্যাট চালিয়ে রানে গতি দিচ্ছিলেন লিটন, অন্যপাশে রনি তালুকদারও তালে তাল মিলিয়ে ইংলিশদের হোয়াইটওয়াশের পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন।
রনি বিদায় নিলেও রানের গতি কমতে দেননি লিটন। অন্য প্রান্তে নাজমুল হোসেন শান্তকে রেখে বোলারদের চারে ভাসিয়ে এগিয়ে যান লড়াকু সংগ্রহের দিকে। নির্ভয় ব্যাটিংয়ের মধ্য দিয়ে তিনি ক্যারিয়ারের নবম ফিফটি তুলে নেন ৪১ বলে। ফিফটি পূরণ করার পর দেখা যায় তার আরেক রূপ। ততক্ষণে নিজের অবস্থান শক্ত করে নিয়ে আরো নিশ্চিন্তে ব্যাট চালাতে শুরু করেন টাইগার টিমের এই উইকেট কিপার। শেষ পর্যন্ত দর্শকদের সেঞ্চুরি উপহার দেয়ার আশা জাগিয়ে ৫৭ বলে ৭৩ রান করে বাউন্ডারি হাঁকানোর চেস্টায় ফিল সল্টের হাতে ধরা পড়েন তিনি। এই ৭৩ রানের ইনিংসই তার ক্যারিয়ারে গড়া সর্বোচ্চ রান। এই ইনিংস গড়তে লিটন ১০টি চার ও একটি ছক্কা হাঁকান। আউট হওয়ার পর তার স্ট্রাইক রেট ছিল ১২৮’এরও বেশি।
লিটন বিদায় নিলেও মাঠ ছাড়ার আগে বাংলাদেশকে ইংলিশদের বাংলাওয়াশ করার পথে অনেকটাই এগিয়ে দিয়ে যান। ব্যাট হাতে দলের সর্বোচ্চ রান করা লিটনের বিচক্ষণতার ফলাফল পাওয়া যায় বাংলাদেশ ফিল্ডিং করতে নামার পরও। প্রথম ওভারেই তার দুরদর্শিতায় প্রথম বেক থ্রু পায় টাইগাররা। তানভির হাসানের বলে প্রথমবারের মতো ব্যাট লাগাতে গিয়ে কট বিহাইন্ডের শঙ্কায় পড়েন ফিল সল্ট। তখন ব্যাটে-বলে হয়েছে এমনটা ছিল প্রায় নিশ্চিত। তবে সেই ক্যাচ ধরে দাঁড়িয়ে না থেকে সুযোগ বুঝে লিটন স্টাম্পিং করে দেন। টিভি আম্বায়ারের রিভিউ শেষে সল্টের ব্যাটে বল না লাগলেও লিটন কুমার দাসের স্ট্যাম্পিংয়ের কারণে সাজঘরের পথ ধরতে হয় ইংলিশ ব্যাটারকে।
এরআগে লিটন নিজের রূপ দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন ২০২২ সালের ২ নভেম্বর ভারতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলতে নেমে। সেই ম্যাচে তিনি ৬০ রান করে সাজঘরে ফিরেন। এরপর আরো তিনটি বিশ ওভারের ম্যাচে তিনি লাল-সবুজের প্রতিনিধিত্ব করতে নামলেও জ্বলে উঠার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অবশেষে টি-টোয়েন্টি বিশ^কাপের পর নিজের চতুর্থ ম্যাচে সফলতা পেলেন তিনি। টি-টোয়েন্টি সংস্করণের ক্রিকেটে এই পর্যন্ত লিটনের নয়টি ফিফটির সবগুলোই দলকে জেতাতে সাহায্য করেছে। তার ব্যাট থেকে যেদিনই ভালো রান এসেছে সেদিনই বদলে গেছে টাইগারদের মোমেন্টাম। একজন ব্যাটার হিসেবে সবচেয়ে ভালো দিক তিনি প্রতিটি অর্ধশতকেই একশোর বেশি স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করেছেন।
বিপিএলের নবম আসর চলাকালে তার ব্যাটিংয়ের ধরন সম্পর্কে জানান, ‘আমি অ্যাটাকিং খেলতে পছন্দ করি। কখনোই এমন হয় না যে আমি ৪০ বলে ৪০ করি, আমি যদি ৪০ বল খেলি, তাহলে ৬০ হয়ে যায়। আমি যেভাবে এতদিন সফল হয়েছি, সে ধারবাহিকতাই বজায় রাখতে চাই।’
টি-টোয়েন্টিতে উইকেটের ‘সেঞ্চুরি’ মোস্তাফিজের
