নিউজ ডেস্আক।। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে জয়ী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের ছাড় দেবে দলটি। তবে এবারে বিদ্রোহী প্রার্থী হলে বারবার ছাড় নয় বলে একাধিক নেতা অভিমত ব্যক্ত করেন।
২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে দলটির ১৭০ জন নেতা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে জয় পান। ভবিষ্যতে নির্বাচন কিংবা দলীয় পদের জন্য তাঁদের বিবেচনায় নেবে আওয়ামী লীগ। সেই সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং দলের জন্য এই নেতাদের অবদান বিবেচনায় এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
দলের কেন্দ্রীয় ওই নেতারা জানান, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে দলের যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তাঁদের আর কখনো মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তবে ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল। সেই নির্বাচনে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল অংশ না নেওয়ায় একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। সে সময়ে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী অংশ নেওয়ায় নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়। এ বিষয়গুলো গত এক বছরে বিভিন্ন সময়ে বিদ্রোহী চেয়ারম্যানরা দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কাছে তুলে ধরেন। এতে নমনীয় হয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ড ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটা বড়সংখ্যক উপজেলা চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এঁরা আমাদের দলেরইমানুষ। দলের জন্য এঁদের অনেকেরই ত্যাগ রয়েছে। এই বিষয় মাথায় রেখেই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তাঁদের দল থেকে বহিষ্কার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আমি মনে করি, আগামী নির্বাচনে ও দলের সম্মেলনে উপজেলার বিদ্রোহীদের বিষয়টি নমনীয়ভাবেই দেখা উচিত। ’
আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী একাধিক উপজেলা চেয়ারম্যান কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশে ৪৯২টি উপজেলা পরিষদ আছে। এর মধ্যে ১৬৮টি থেকে ১৭০টি উপজেলায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী চেয়ারম্যান হয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পঞ্চগড়ে পাঁচ উপজেলার মধ্যে একটি, কুড়িগ্রামে ৯ উপজেলার মধ্যে চারটি, লালমনিরহাটে পাঁচ উপজেলার মধ্যে তিনটি, নীলফামারীতে ছয় উপজেলার মধ্যে দুটি, দিনাজপুরে ১৩ উপজেলার মধ্যে তিনটি, গাইবান্ধায় সাতটির মধ্যে দুটি, লক্ষ্মীপুরে পাঁচটির মধ্যে একটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী উপজেলা চেয়ারম্যান রয়েছেন। পাবনায় চার, নাটোরে দুই, চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক, জয়পুরহাটে এক, বগুড়ায় দুই, চট্টগ্রামে তিন, কক্সবাজারে দুই, নওগাঁয় তিন, বরিশালে তিন এবং সিরাজগঞ্জের একটি উপজেলায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান রয়েছেন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক সূত্র জানায়, অন্য নির্বাচনে বিদ্রোহীদের প্রতি কঠোর হলেও ২০১৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহী নেতাদের দল থেকে বের করে দেওয়া হয়নি। যোগ্যতা অনুসারে অনেক নেতাকেই দলীয় পদ দেওয়া হয়েছে। নওগাঁর আত্রাইয়ের বিদ্রোহী উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। আগামী জাতীয় নির্বাচন কিংবা দলের বিভিন্ন শাখা কমিটির সম্মেলনে পদপ্রার্থী হতে পারবেন বিদ্রোহী চেয়ারম্যানরা।
রাজশাহী বিভাগের একটি উপজেলা থেকে নির্বাচিত একজন বিদ্রোহী চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে অনেককে বিদ্রোহী প্রার্থী হতে উৎসাহ দেন। নির্বাচন শেষে এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, যে নেতারা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে জিতেছেন তাঁরা তো আওয়ামী লীগেরই।
পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে দলের বিপুলসংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থী দেখা যায়। এ পরিস্থিতিতে দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা এবং আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের বেশিসংখ্যক প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে কঠোর হন কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারকরা। বিদ্রোহী প্রার্থীদের আর কখনো দলীয় মনোনয়ন এবং দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশির ভাগ উপজেলায়ই দীর্ঘদিন ধরে দল করে আসছেন এমন নেতারা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে জয় পেয়েছেন। স্থানীয় নেতাকর্মীদের সহযোগিতা পেয়েই ওই নেতারা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। প্রার্থী বাছাইয়ে দলের মনোনয়ন বোর্ড সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে না পারার কারণেও অনেকে বিদ্রোহী প্রার্থী হন।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতার কারণ দেখিয়ে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেয় বিএনপি। পরে বিএনপি ঘনিষ্ঠ কয়েকটি দলও নির্বাচন বর্জন করে। ফলে নির্বাচনে বহু উপজেলায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এমন বাস্তবতায় অনেকে বিদ্রোহী প্রার্থী হন। এর পরও অর্ধশতাধিক উপজেলায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নির্বাচিত হন।
আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানায়, বিদ্রোহী উপজেলা চেয়ারম্যানদের নিজেদের এলাকায় শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে—এটা বুঝতে পেরেছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। সব দিক বিবেচনায় নিয়েই বিদ্রোহীদের ছাড় দেওয়ার পথ বেছে নেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘উপজেলার বিদ্রোহীদের মনোনয়ন দেওয়া হবে কি না, সেটা নিয়ে এখনো তো আমরা কিছু বলিনি। ফলে আগে থেকে ধরে নেওয়ার কিছু নেই। সাম্প্রতিক নির্বাচনে যাঁরা স্থানীয় সরকারে নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন তাঁদের মনোনয়ন দেওয়া হবে না। পাঁচ বছর আগের ঘটনার সঙ্গে এখনকার পরিস্থিতি মেলালে চলবে না। আগের বিদ্রোহীদের হয়তো এবারে সুযোগ দেওয়া হবে। ’