ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। প্রথম ব্রিটিশ এশিয়ান এবং এক শতকের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সি প্রধানমন্ত্রী হতে যাওয়া সুনাক যুক্তরাজ্যে নতুন ইতিহাস গড়ছেন। ক্ষমতাসীন দল কনজারভেটিভ পার্টির (টোরি) শীর্ষ নেতা হওয়ার দৌড় থেকে সর্বশেষ সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী পেনি মরডান্ট সরে যাওয়ার পর সাবেক অর্থমন্ত্রী সুনাকের ভাগ্য খুলে যায়। এর আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সরে দাঁড়ান। সোমবার ৪২ বছর বয়স্ক সুনাককে টোরির নেতা ঘোষণা করা হয়। এর মাধ্যমে সেপ্টেম্বরে লিজ ট্রাসের কাছে হেরে যাওয়া সুনাক তারই স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন। মঙ্গলবার নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তার শপথগ্রহণের কথা রয়েছে। এরই মধ্যে একের পর অভিনন্দন বার্তায় তিনি ভাসছেন। খবর বিবিসি, এএফপি ও রয়টার্সের।
প্রধানমন্ত্রী ও কনজারভেটিভ পার্টির নেতা হওয়ার লড়াইয়ে থাকা সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী পেনি মরডান্ট সোমবার শেষ মুহূর্তে তার নাম প্রত্যাহার করে নেন। ১০০ এমপির সমর্থন পাওয়ার পরও তিনি সরে দাঁড়ান। সুনাক পেয়েছেন মোট টোরি এমপির অর্ধেকের সমর্থন। লন্ডনের স্থানীয় সময় সোমবার কনজারভেটিভ পার্টির ১৯২২ কমিটির চেয়ারপারসন স্যার গ্রাহাম ব্রাডি ঘোষণা করেন- দলের নতুন নেতা নির্বাচনে শুধু সুনাকের মনোনয়নপত্র পেয়েছেন তারা। এ কারণে তাকে নতুন দলীয় প্রধান ঘোষণা করা হলো। যুক্তরাজ্যে ক্ষমতাসীন দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী হন। ২০ অক্টোবর লিজ ট্রাস প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করার পর কনজারভেটিভ পার্টির নতুন নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। টোরি দলের নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর সুনাক তার প্রতিক্রিয়া জানাতে মঞ্চে উঠলে দলের এমপিরা করতালি দিয়ে তাকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, অর্থনীতির গতি ফেরাতে ও জনগণের করের বোঝা কমাতে চান তিনি।
ক্ষমতাসীন দলের নেতা এবং পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় ঋষি সুনাককে অভিনন্দন জানিয়েছেন সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস। টুইটারে দেওয়া পোস্টে ঋষি সুনাকের প্রতি নিজের পূর্ণ সমর্থনের কথাও জানান ট্রাস। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন, চ্যালেঞ্জিং সময়ে আমাদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় ঋষি সুনাককে অভিনন্দন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে সুনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজিওন ঋষিকে অভিনন্দন জানিয়ে আগাম নির্বাচন দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
টুইটারে দেওয়া পোস্টে নিকোলা স্টারজিওন বলেন, ঋষি সুনাককে অভিনন্দন। তার প্রতি শুভ কামনা। আমাদের রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও আমরা যাদের সেবা করি তাদের স্বার্থে তার সঙ্গে একটি গঠনমূলক কাজের সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব। স্কটিশ ফার্স্ট মিনিস্টার বলেন, ঋষি যে প্রথম এশীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন সেটি সত্যিকার অর্থেই একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী ঋষি সুনাক ২০১৫ সালে রিচমন্ডের নর্থ ইয়র্কশায়ার থেকে প্রথমবার ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। পাঁচ বছরের কম সময়ের মধ্যে ২০২০ সালে তিনি বরিস জনসন সরকারের অর্থমন্ত্রী হন। ১৯৮০ সালে সাউদাম্পটনে ভারতীয় বংশোদ্ভূত বাবা-মায়ের ঘরে সুনাক জন্ম নেন। তারা পূর্ব আফ্রিকা থেকে যুক্তরাজ্যে এসেছিলেন। তারা বাবা ছিলেন চিকিৎসক। আর মা একটি ফার্মেসি চালাতেন। উইনচেস্টার কলেজের প্রাইভেট বোর্ডিং স্কুল, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন সুনাক। ভারতীয় বিলিয়নিয়ারের মেয়ে আকশাতা মুর্তিকে বিয়ে করেছেন ঋষি সুনাক। তাদের ঘরে দুটি কন্যা সন্তান রয়েছে। আকশাতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে পরিচয় হয় সুনাকের।
সাত সপ্তাহ আগে লিজ ট্রাসের কাছে সুনাক হেরেছিলেন। দলের নেতা হওয়া লিজ ট্রাস মাত্র ৪৫ দিন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পেরে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে তিনি বাধ্য হন। এরপর আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে নামেন ৪২ বছর বয়স্ক ঋষি সুনাক। সর্বশেষ সোমবার পেনি মরডান্ট সরে দাঁড়ানোয় সুনাক তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যান। ব্রিটিশ পত্রিকাগুলো সোমবারের খবরে নিশ্চিত করেছিল- সুনাকই হচ্ছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী।
কনজারভেটিভ পার্টির নেতা হওয়ার লড়াইয়ে থাকছেন না বলে রোববার রাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ঘোষণা দেন। তার এ ঘোষণার পর সুনাকের ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যুক্তরাজ্যের পত্রিকাগুলোও সুনাকের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে প্রথম পাতায় শিরোনাম ও খবর প্রকাশ করে। সোমবার দ্য টাইমসের খবরে বলা হয়, বরিস জনসন নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ পরিষ্কার হলো সুনাকের জন্য। প্রথম পাতায় ঋষি সুনাকের বড় ছবিও ছেপেছে পত্রিকাটি। ডেইলি এক্সপ্রেসের শিরোনামে বলা হয়, বরিসের সরে যাওয়ায় নতুন প্রধানমন্ত্রী হতে অপেক্ষায় ঋষি সুনাক (ঋষি নিউ পিএম ইন ওয়েটিং, আফটার বরিস কুইটস রেস)। দ্য সানের শিরোনাম- জনবিশৃঙ্খলা এড়াতে জনসন না দাঁড়ানোয় পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী ঋষি। দ্য আই জানায়- ‘বরিস জনসন লড়াই থেকে সরে যাওয়ায় এখন সবার থেকে এগিয়ে ঋষি সুনাক। ডেইলি মিরর ও দ্য সান একই রকম শিরোনাম করেছে। দুটি পত্রিকার শিরোনামে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন ঋষি সুনাক। আরেকটি পত্রিকা লেখে- ‘সুনাক সেট ফর পাওয়ার।’
নেতা হওয়ার লড়াই থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণায় বরিস জনসন বলেন, আপাতত প্রধানমন্ত্রীর হওয়ার দৌড়ে থাকা ঠিক হবে না। তিনি জানান, পার্লামেন্টে কনজারভেটিভ পার্টির আইনপ্রণেতারা যদি একতাবদ্ধ না হন তবে কার্যকরভাবে সরকার পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তিনি জানান, পার্লামেন্টে ১০২ জন আইনপ্রণেতা তাকে সমর্থন করছিলেন। তবে বিবিসি বলছে, বরিসকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছেন এমন আইনপ্রণেতার সংখ্যা আসলে ৫৭ জন। এ নির্বাচন না লড়লেও ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের দিকে নজর রাখছেন বরিস। সেই ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, আগামী ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টিকে বিজয় এনে দিতে পারব। করোনাকালে অর্থনৈতিক চাপ সামলানোর জন্য প্রশংসা পেয়েছেন সুনাক। এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর দৌড় থেকে সরে দাঁড়ানোর পর বরিস জনসনের প্রশংসা করেছেন সুনাক। টুইট বার্তায় তিনি লিখেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদে (ব্রেক্সিট) ও করোনাভাইরাসের টিকা কর্মসূচি বাস্তবায়নে দুর্দান্ত কাজ করেছেন বরিস।
সুনাককে চার্চিলের সঙ্গে তুলনা ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রীর : ব্রিটেনের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হচ্ছেন- এ নিয়ে দেশটির একাধিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে এগিয়ে থাকা ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাককে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে উইনস্টন চার্চিলের সঙ্গে তুলনা করেছেন অর্থমন্ত্রী জেরেমি হান্ট। উল্লেখ্য, একবিংশ শতাব্দীর একজন সম্মানিত ও দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদ ছিলেন উইনস্টন চার্চিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৮৭৪ সালের ৩০ নভেম্বর ইংল্যান্ডের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
ব্রিটেনের অর্থনৈতিক সংকটে লিজ ট্রাস যখন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শেষদিনগুলোতে সরকার চালাতে একটা বাজে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন অর্থমন্ত্রী হিসাবে জেরেমি হান্টকে নিয়োগ দেন। তিনি পরিস্থিতি কিছুটা সামলে নিলেও এমপিদের তুমুল চাপের মুখে পদত্যাগ করেন ট্রাস। এ অবস্থায় কনজারভেটিভ পার্টির নতুন নেতৃত্বে ঋষি সুনাকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেখতে আগ্রহী জেরেমি হান্ট। রোববার তিনি বলেন, আমাদের অর্থনীতি, বাজারের গ্রহণযোগ্যতা এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। স্থিতিশীলতা ও আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধারে আমাদের এমন একজন নেতার প্রয়োজন যাকে বিশ্বাস করা যায়। অবশ্য আমাদের একজন নেতা ঋষি সুনাক তা করতে পারেন।