কাঁটাতারের দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে একে অপরের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কথাবার্তা। বিএসএফের অনুমতি নিয়ে কাঁটাতারের বেড়ার গেট দিয়ে ঢুকে কয়েকজন নিজের গুরুজনদের পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছেন। আবার কেউ কেউ পরিজনদের পেয়ে মোবাইলে সেল্ফি তুলছেন। গতকাল মঙ্গলবার এই দৃশ্যের সাক্ষী থাকলেন মেখলিগঞ্জ ব্লকের কুচলিবাড়ির হেদুরটারি ও বল্টুরটারির বাসিন্দারা।
দুই বাংলার বাধা কাঁটা তারের বেড়া। আর বাকিটা দশটা দিন কাঁটা তারের ধারে কাছে গ্রামবাসীদের বা বাইরের কাওকেই আসতে দেয় না বিএসএফ। আসলেও অনেক কৈফিয়ত দিতে হয়। কিন্তু কালীপুজোর পরদিন মেখলিগঞ্জের কুচলিবাড়ি সীমান্তে হেদুরটারি ও বল্টুরটারি সীমান্তে বিএসএফ দুই দেশের মানুষ আত্মীয় পরিজনদের মধ্যে সাক্ষাৎ করার সুযোগ দেন। এর ফলে এইদিনটির দিকেই মুখিয়ে থাকেন দুই বাংলার মানুষ। পূজার পর কুচলিবাড়ি সীমান্তে জমায়েত হন প্রচুর মানুষ। রীতিমতো মিলন মেলার আকার নেয় এলাকা। কাঁটাতারের দুপারের দুদেশের মানুষ নিজেদের আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। কুশল বিনিময় করেন। বিএসএফের অনুমতি নিয়ে অনেকে কয়েক মিনিটের জন্য গেটের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের ভূখন্ডে প্রবেশ করে আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পায়। শুধু কুচলিবাড়ি সীমান্ত লাগোয়ার মানুষজনই নয়, দূরদূরান্ত জেলাগুলি থেকেও হাজির হন এই মিলন মেলাতে।
বাংলাদেশের হাতিবান্ধা উপজেলার ফকিরপাড়ার বাসিন্দা কল্পনা রানী এসেছেন ভারতে থাকা বোনের সঙ্গে দেখা করতে। তার দাবি, ‘মাঝেমধ্যে ফোনে ভিডিও কলের মাধ্যমে কথাবার্তা হলেও সামনাসামনি কথা বলার অনুভূতিই আলাদা। তাই মিলন মেলায় এসেছি বোনের সঙ্গে দেখা করতে।’ একই কথা বলেন জলপাইগুড়ির শম্ভু রায়ও। তিনি বলেন, ‘আমাদের বংশের অর্ধেক মানুষ দেশ ভাগের সময় ভারতে এসেছেন। বাকিরা বাংলাদেশেই রয়েছে। তাদের সঙ্গে দেখা করতেই এসেছি।’ পাশাপাশি কিন্তু কাঁটাতারের সীমানা সংলগ্ন প্রচুর মানুষও এসেছেন তাদের আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে দেখা করতে। তাদের দাবি আগে কাঁটাতার ছিল না। সীমান্তে কড়াকড়িও ছিল না। তাই দুই দেশের মধ্যে বিয়েও হত। কিন্তু কাঁটাতারের বেড়া হওয়ার পর আর যাওয়া আসা হয় না। স্থানীয় যুবক জ্যোতিবিকাশ রায় বলেন, ‘আমাদের এখানকার অনেক মানুষের আত্মীয় পরিজন রয়েছেন বাংলাদেশে। তাদের কথা ভেবেই বিএসএফ একদিনের জন্য অনুমতি দেন মিলন মেলার। তাই প্রত্যেক বছর কাঁটাতারের দুই দিকে প্রচুর মানুষ ভীড় জমান।’
এমন দিনের অপেক্ষায় ছিলেন ধুপগুড়ির গৃহবধূ প্রতিমা রায় সহ চালসা, শিলিগুড়ি সহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তের প্রচুর মানুষ। এদিন তাঁরা বাংলাদেশে বসবাসকারী আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন। ধুপগুড়ির প্রতিমা রায় বলেন, ‘আমার বাবা মা সহ পরিবারের অনেক সদস্য এখনও বাংলাদেশের পাটগ্রামে রয়েছে। পাসপোর্ট করে বাংলাদেশে যেতে পারি না। তাই প্রত্যেক বছর বাবা মায়ের মুখ দেখতে আসি।’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন প্রতিমা। আঁচল দিয়ে চোখ মুছেই বললেন, ‘উৎসবের দিন গুলোতে বেশী করে বাবা মায়ের কথা মনে পড়ে। বিএসএফকে ধন্যবাদ জানাই আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়ার জন্য। আমি বাবা মায়ের পায়ের হাত রেখে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিতে পেরেছি।’ বাংলাদেশের ষাটোর্ধ দম্পতি হরিমন রায় ও সুমতি রায়ের বাড়ি পাটগ্রামের ঘোষপাড়ায়। মেয়ে ফুলমতির বিয়ে হয় ভারতের জামালদহে। প্রত্যেক বছরের মত এবার মিলন মেলায় এসেছেন। হরিমন রায়ের বক্তব্য, ‘মেয়েকে দেখার জন্য বছরভর অপেক্ষায় থাকি।’