Home জাতীয় বলেশ্বর নদীতে ইলিশের নতুন প্রজনন ক্ষেত্রের সন্ধান

বলেশ্বর নদীতে ইলিশের নতুন প্রজনন ক্ষেত্রের সন্ধান

নিউজ ডেস্ক

by Nahid Himel

দেশের মৎস্য বিজ্ঞানীরা দক্ষিণাঞ্চলের বলেশ্বর নদীতে ইলিশের নতুন প্রজনন ক্ষেত্রের সন্ধান পেয়েছে। তারা বলেছেন, বলেশ্বর নদীতে নতুন প্রজনন কেন্দ্র করা হলে সেখান থেকে বছরে ৫০ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ বাড়তি পাওয়া যাবে। যার আর্থিক মূল্য ২৬৪ কোটি টাকা। এতে ইলিশের উৎপাদন বছরে প্রায় সাত লাখ মেট্রিক টনে গিয়ে দাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে।

তাই বর্তমানে দেশে যে চারটি প্রজনন কেন্দ্র রয়েছে, তার পাশাপাশি বলেশ্বর নদীকেও ইলিশের প্রজননের জন্য নতুন একটি সংরক্ষিত কেন্দ্র ঘোষণার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।  সেই সঙ্গে গবেষণা থেকে পাওয়া ফলের ওপর ভিত্তি করে সরকারের কাছে একটি ১০ দফা সুপারিশও পাঠানো হয়েছে।

জানা যায়, বাংলাদেশ মৎস গবেষণা ইনষ্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতিক এক গবেষণায় বলেশ্বর নদীতে ইলিশের ব্যাপক প্রজননের সম্ভাবনার প্রমাণ পেয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বলেশ্বর নদীর মোহনা অঞ্চলে ইনস্টিটিউট এই গবেষণাটি চালিয়েছে। বলেশ্বর নদী মূলত দক্ষিণাঞ্চলীয় বাগেরহাট, পিরোজপুর এবং বরগুনা জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। এছাড়া বলেশ্বর নদীর মোহনায় মিশেছে বিষখালী, পায়রা, আন্ধারমানিক ও লতাচাপলী নদী। এর সঙ্গে সুন্দরবনের ভোলা নদী, সুপতি খাল, দুধমুখী খাল এবং ছোট কটকা খাল সংযুক্ত। মূলত এসব অঞ্চল জুড়ে গবেষণাটি চালানো হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেছেন, গবেষণায় তিনটি বিষয় আমরা দেখতে পেয়েছি। এগুলো হলো, গবেষণা চলাকালে ওই অঞ্চলে প্রজননক্ষম ইলিশের আধিক্য দেখা গেছে। দ্বিতীয়ত, সেখানে ইলিশের বসবাসের অনুকূল পরিবেশ বিদ্যমান ছিল। এর মানে হচ্ছে, সাগর থেকে ইলিশ যখন ডিম ছাড়ার জন্য নদীতে আসে, মানে উজানে আসে তখন নদীর যে প্ল্যাংটন বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী খায়, বলেশ্বর নদীর মোহনায় তার প্রাচুর্য ছিল। এছাড়া, গবেষণা চলাকালে গবেষকেরা ওই অঞ্চলে লার্ভি অর্থাৎ ডিম ফুটে বেরুনো বাচ্চা ইলিশ এবং জাটকাও সেখানে প্রচুর পরিমাণে ছিল।
গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এর আগে যে চারটি ইলিশের প্রজনন কেন্দ্র করা হয়েছে, তার সাথে এই এলাকার জলজ পরিবেশ এবং মাছের ডিম ছাড়ার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে। এসব কারণে এখন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট মনে করে, বলেশ্বর নদী ও মোহনা অঞ্চল ইলিশের একটি সম্ভাবনাময় প্রজননক্ষেত্র। সেজন্য বলেশ্বর নদীর প্রায় ৫০ কিলেমিটার দীর্ঘ এবং প্রায় সাড়ে ৩০০ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত অঞ্চল নিয়ে একটি নতুন প্রজনন কেন্দ্র করার প্রস্তাব করেছে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট।

গবেষণা থেকে পাওয়া ফলের ওপর ভিত্তি করে সরকারের কাছে একটি ১০ দফা সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। বলা হয়েছে, এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন বছরে আরো ৫০ হাজার মেট্রিক টন বাড়বে, যার আর্থিক মূল্য ২৬৪ কোটি টাকা। এতে ইলিশের উৎপাদন বছরে প্রায় সাত লাখ মেট্রিক টনের মত হওয়ার আশা করছে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে যে ১০টি সুপারিশ দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে, নদ-নদী এবং সাগর থেকে আগামী দুই-তিন বছর পর্যন্ত ইলিশ আহরণের সীমা নির্ধারণ করে দেয়া। এছাড়া মার্চ-এপ্রিল মাসে জাটকার সুরক্ষা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা কঠোরভাবে বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। সেই সাথে প্রতিটি ইলিশকে তার জীবনচক্রে অন্তত একবার ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতে হবে।

সুপারিশে আরো বলা হয়েছে, প্রতিটি জাল এবং জেলে নৌকা ডিজিটাল ট্যাগিংয়ের আওতায় আনা এবং মৌসুমে মাছ ধরা জালের ফাঁসের আকার সাড়ে ছয় সেন্টিমিটারের কম হতে পারবে না। এ ছাড়া ইলিশ যেহেতু একেক নদীতে একেক সময় ডিম পাড়ে, সে কারণে যখন যে নদীতে ডিম ছাড়বে ইলিশ, সে সময় অনুযায়ী ওই নদীতে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। তাছাড়া দেশে ইলিশের মজুত ও আহরণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যানের পাওয়ার ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে ইলিশের বার্ষিক উৎপাদন ছিল ৫ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন। বর্তমানে দেশে মোট মাছের উৎপাদনের ১২ দশমিক ২১ শতাংশ ইলিশ, জিডিপিতে যার অবদান বছরে এক শতাংশ।
মৎস্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য বলছে, আগের ১০ বছরে ইলিশের উৎপাদন ৭৫ শতাংশ বেড়েছে। ওয়ার্ল্ডফিশের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে চারটি প্রজনন ক্ষেত্র এবং ছয়টি অভয়াশ্রম আছে। এরমধ্যে চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে শুরু করে ভোলার লালমোহন উপজেলা পর্যন্ত ইলিশের সবচেয়ে বড় প্রজনন ক্ষেত্র। এছাড়া, মনপুরা, ঢালচর, বালিরচর, মৌলভীরচর-এগুলো হচ্ছে ইলিশের ডিম ছাড়ার সবচেয়ে বড় পয়েন্ট। চট্টগ্রাম, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চাঁদপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা মিলিয়ে প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ইলিশ মাছ সবচেয়ে বেশি ডিম ছাড়ে। এর বাইরের উপকূলের অন্যান্য নদীগুলোতেও ইলিশ ডিম ছাড়ে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, যে ছয়টি নদী এলাকাকে ইলিশের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে, সেসব জায়গায় ইলিশের ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন বেড়েছে।ইলিশের অভয়াশ্রমগুলো মূলত মেঘনা নদী ও এর অববাহিকা এবং পদ্মা ও মেঘনার সংযোগস্থলে অবস্থিত। এর মধ্যে চাঁদপুরে মেঘনা নদীর নিম্ন অববাহিকার ১০০ কিলোমিটার এলাকা, ভোলায় মেঘনা নদীর শাহবাজপুর শাখা নদীর ৯০ কিলোমিটার এলাকা, তেঁতুলিয়া নদীর প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকা অন্যতম।

এছাড়া পদ্মা নদীর ২০ কিলোমিটার এলাকা, বরিশালের হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জে মেঘনা নদীর প্রায় ৮২ কিলোমিটার এলাকা। এসব অভয়াশ্রমে বছরে নির্দিষ্ট সময় ইলিশ ও জাটকাসহ সব ধরনের মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকে। এই সময় মাছ ধরা, বিক্রি, বিপণন, মজুত ও পরিবহন নিষিদ্ধ থাকবে। এর লঙ্ঘন করা হলে জরিমানা ও কারাদন্ডের বিধান রয়েছে।

এই বিভাগের আরো খবর

Leave a Comment