নাটোর-২ (সদর-নলডাঙ্গা) আসনের সংসদ-সদস্য (এমপি) শফিকুল ইসলাম শিমুলের সঙ্গে দুই উপজেলা চেয়ারম্যানের দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করেছে।
অনেক দিন ধরে দুইবারের এমপি শিমুলের সঙ্গে তার নির্বাচনি এলাকার নিজ দলের উপজেলা চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম রমজান (সদর) এবং উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান আসাদ (নলডাঙ্গা) বিরোধ চলে আসছে। এ কারণে নাটোরে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন।
অপর দিকে সাবেক উপমন্ত্রী অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস দুলুর কথাই হলো নাটোরে বিএনপির শেষ কথা। তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
গত বছরের শুরুতে এমপি শিমুলবিরোধী হিসাবে পরিচিত ইসতিয়াক আহমেদ ডলার ও শফিউল আযম স্বপনের হাতে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটি চলে যায়। এতে শিমুল চরম ক্ষুব্ধ হন। তার সমর্থিত জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আগের কমিটি সংবাদ সম্মেলন করে ডলারের বাবাকে রাজাকার বলে দাবি করে।
তবে পালটা সংবাদ সম্মেলন করে ডলার ও স্বপন দাবি করেন-এমপি শিমুলের বাবাই রাজাকার ছিলেন। এ সংক্রান্ত বইসহ কিছু তথ্য উপস্থাপন করেন ডলার। এ দাবি ও পালটা দাবির কারণে নাটোরে আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
জেলার বাকি চার এমপি একাট্টা হয়ে এমপি শিমুলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। জেলা আওয়ামী লীগকে রক্ষা করতে তারা এমপি শিমুলের বিরুদ্ধে দলের সভাপতির কাছে অভিযোগ করেন। সাত বছর দায়িত্ব পালন শেষে ২০ ফেব্রুয়ারি জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে শিমুল সাধারণ সম্পাদকের পদ হারান। সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম রমজান সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান।
এ সম্মেলনের আগে এমপি শিমুল ও চেয়ারম্যান রমজানের অনুসারীরা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। তবে এর আগে থেকে দুই নেতা ও তাদের অনুসারীরা আলাদাভাবে দলীয় কর্মসূচি পালন করতেন। সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর দলের অস্থায়ী জেলা কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নেন রমজান।
শিমুলের বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াত থেকে লোকজন এনে হাইব্রিড আওয়ামী লীগ বানানোর অভিযোগ করেছেন রমজানের অনুসারী নেতাকর্মীরা। দুই নেতার দ্বন্দ্বে সাধারণ নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংসদীয় এলাকার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ছয়টিতে নৌকা পরাজিত হয়েছে।
ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিন সেনা সরকারের সময় মামলা দেওয়া এবং সেই মামলায় দুলুসহ বিএনপি নেতাদের সাজা হওয়ায় আওয়ামী লীগে বিশেষ পরিচিতি পান নলডাঙ্গা উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান আসাদ। তার সঙ্গেও এমপি শিমুলের বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে।
চেয়ারম্যান আসাদের পারিবারিক বিরোধের জেরে ২৩ সেপ্টেম্বর উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা জামিউল আলম জীবন মারা যান। এ ঘটনায় আসাদের ফাঁসির দাবিতে ডাকা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এমপি শিমুল। ৩১ অক্টোবর থেকে আসাদ কারাগারে রয়েছেন। নলডাঙ্গা পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেনও এমপি শিমুলবিরোধী।
বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন ছাড়াও বাস মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়ন, চামড়া ব্যবসায়ী সমিতি, দলিল লেখক সমিতিসহ জেলা সদরের বিভিন্ন সংগঠনের কমিটি শিমুলের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া হয়। ২০১৯ সালে শিমুলের অনুসারী রইস উদ্দিন রুবেলকে সভাপতি ও তৌহিদুর রহমান লিটনকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত নলডাঙ্গা থানা আওয়ামী লীগের কমিটি বাতিল করে কেন্দ্র।
এরপর ঢাকা থেকে আবদুস শুকুরকে সভাপতি ও মুশফিকুর রহমান মুকুকে সাধারণ সম্পাদক করে নলডাঙ্গা থানা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করা হয়।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম রমজান বলেন, এমপি শিমুলের সঙ্গে সভা সেমিনারে দেখা হলেও তেমন কোনো কথা হয় না। একটি বিশেষ বলয় নিয়ে চলেন এমপি। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে এমপি শিমুলের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। দুর্নীতিগ্রস্ত, হাইব্রিড, বিএনপি ও জামায়াত সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে চলা ফেরা করেন। বিদেশে বাড়ি-গাড়ি করায় সাধারণ মানুষ তাকে (এমপি শিমুল) আর পছন্দ করছে না। সাধারণ মানুষ পরিবর্তন চায়। আগামী সংসদ নির্বাচনে নাটোর সদরে অবশ্যই আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরিবর্তন হওয়া জরুরি।
নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও নাটোর-২ (সদর-নলডাঙ্গা) আসনের এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুল যুগান্তরকে বলেন, নলডাঙ্গা উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান আসাদ ছাত্রশিবিরের লোক। শিবিরের পর জাতীয় পার্টি হয়ে কিছু লোকজনের মাধ্যমে আসাদ আওয়ামী লীগে এসেছে। তার কোনো জনপ্রিয়তা নেই। দলের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে তিনি (আসাদ) এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। ছাত্রলীগ নেতা জীবনকে আসাদ পিটিয়ে হত্যা করেছে।
এমপি শিমুল আরও বলেন, জঙ্গি বাংলা ভাইয়ের সহযোগিতায় বিএনপি নেতা দুলু নাটোরের মানুষকে জিম্মি করে ফেলেছিলেন। দুলুর সন্ত্রাস শক্ত হাতে দমন করে নাটোরের উন্নয়ন করায় প্রধানমন্ত্রী আমাকে দুইবার এখানে মনোনয়ন দিয়েছেন। দায়িত্ব আমি সঠিকভাবে পালন করেছি। সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম রমজান দলে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান। এজন্য তার (শিমুল) অনুসারী নেতাকর্মীদের তিনি (রমজান) নানাভাবে হয়রানি করছেন। ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের বাদ দিয়ে জেলা, উপজেলা, পৌর ও ইউনিয়ন পর্যায়ে পছন্দের লোক দিয়ে একপেশে কমিটি করা হয়েছে।
এমপি শিমুল আরও বলেন, যে যাই বলুক, দলের সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশনা মেনে তিনি কাজ করেন এবং সারাজীবন তিনি সেটাই করে যেতে চান।
নাটোর সদর আসনে অনেক আগে থেকে বিএনপির শক্ত অবস্থান রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে নাটোরে আওয়ামী লীগের শংকর গোবিন্দ চৌধুরী ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৯১ সালে নির্বাচনের পর তার মৃত্যু হলে উপনির্বাচনে অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু নির্বাচিত হন।
প্রায় ১৫ বছর ধরে নাটোর সদর আসনে তিনি জনপ্রিয় নেতা। সেনা সরকারের সময়ের দুটি মামলায় রায় হওয়ায় তিনি নির্বাচন করতে পারেননি। তিনবারের সাবেক এমপি দুলু বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, নাটোরের বর্তমান এমপি বিনা ভোটে নির্বাচিত বলে তার (শিমুলের) কোনো জবাবদিহিতা নেই। শিমুলের আমলে শুধু বিএনপি আর সাধারণ মানুষ নয়, আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, বিএনপি মানুষের ভাত ও ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আন্দোলন করছে।
তিনি আরও বলেন, নাটোরে বিএনপির মধ্যে কোনো লবিং গ্রুপিং কোন্দল নেই। জেলা বিএনপির সদস্য সচিব রহিম নেওয়াজ বলেন, নিরপেক্ষ ভোট হলে শুধু নাটোর সদর আসন নয়, জেলার যেকোনো আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে অ্যাডভোকেট দুলু বিজয়ী হবেন।