নিউজ ডেস্ক ৷৷ রাজধানীর বাড্ডার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা রইজ উদ্দিন কালু। প-১৩৬/১/১ দক্ষিণ বাড্ডায় সোয়া নয় কাঠা জমির মালিক তিনি। নিজ জমিতে ‘অদ্বিতীয়া’ ভবন নির্মাণের জন্য ডেভেলপার কোম্পানি দ্য বেঙ্গল ওয়ান ক্রিয়েশন লিমিটেডের (বিওসিএল) সঙ্গে ২০০৭ সালের ৫ মার্চ চুক্তি করেন। বিওসিএল-এর পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী সোহেল রানা এ চুক্তিতে সই করেন। তিনি রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সহসভাপতি (অর্থ)। চুক্তি অনুযায়ী ৩২টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ৩২ শতাংশ পাওয়ার কথা কালুর।
শুধু এই একটি ঘটনাই নয়, রিহ্যাব সহসভাপতি শতাধিক মানুষের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা যায়, ১০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি জমি মালিকদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। সোহেল রানা ও তার প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে থানা এবং আদালতে অন্তত ১৬টি মামলা হয়েছে। জাতির পিতার বিরুদ্ধে কটূক্তির অভিযোগে করা মামলায় এরই মধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। ওই মামলার বিচারকাজ চলমান। প্রভাবশালী হওয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে রিহ্যাবে অভিযোগ দিয়েও কোনো লাভ হয় না ভুক্তভোগীদের। সার্বিক বিষয় উল্লেখ করে ভুক্তভোগীদের পক্ষে ১১ নভেম্বর ডিএমপি রমনা বিভাগের উপকমিশনারের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহীদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, রিহ্যার সহসভাপতি এবং বিওসিএল এমডির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগের বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নিউমার্কেট জোনের সহকারী কমিশনারকে নির্দেশ দিয়েছি। নিউমাকের্ট জোনের সহকারী কমিশনার শরীফ মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামান বলেন, সোহেল রানার বিরুদ্ধে ডিসি অফিস থেকে যে অভিযোগ এসেছে, সেটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে একজন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলা যাচ্ছে না।
ভুক্তভোগী রইজ উদ্দিন কালু জানান, বিওসিএল-এর সঙ্গে ভবন নির্মাণের চুক্তি করে চরম বিপাকে পড়েছি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী সোহেল রানা ভবনের বিপরীতে ব্যাংক এশিয়া থেকে আট কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। সেটি সুদসহ এখন নয় কোটি টাকা হয়েছে। কিন্তু তিনি ওই টাকা পরিশোধ করেননি। এ কারণে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অসম্পন্ন সব ফ্ল্যাট বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ফ্ল্যাট বুঝে নিলে সাধারণ ক্রেতারা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়বে।
ব্যাংক এশিয়ার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আরশাদুল কবির ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, ঋণ পরিশোধ না করার কারণে আমরা প্রকৌশলী সোহেল রানার বিরুদ্ধে মামলা করেছি। পাশাপাশি যেসব ফ্ল্যাটের বিপরীতে তিনি ঋণ নিয়েছেন, সেগুলো ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আদালতে আবেদন জানিয়েছি। আশা করছি আমরা ন্যায়বিচার পাব।
নবাবগঞ্জের বাসিন্দা বেসিক ব্যাংকে কর্মরত জহির উদ্দিন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের ১১/২ নম্বর রোডে ২ হাজার ১০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কেনার জন্য ২০১১ থেকে ১৩ সালে আমি ৯৪ লাখ টাকা দিই সোহেল রানাকে। ২০১৪ সালে ফ্ল্যাট বুঝে দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা দেওয়া হয়নি। এমনকি পাঁচ বছর ধরে ওই ভবনের কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। একই ভবনে আমার মতো আরও চারজন ভুক্তভোগী আছে। এ বিষয়ে রিহ্যাবে অভিযোগ দেওয়া হলেও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। এক প্রশ্নের জবাবে জহির উদ্দিন বলেন, দীর্ঘদিনেও ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দেওয়ায় আমি সোহেল রানার কাছে টাকা ফেরত চাই। তিনি আমাকে ৪০ লাখ টাকা করে দুটি চেক দেন। কিন্তু যে চেক দেওয়া হয়, সেই চেকের বিপরীতে ব্যাংকে কোনো টাকা নেই। তাই ২০১৮ সালে তার বিরুদ্ধে একটি চেক ডিজঅনার মামলা করি। মামলাটি এখন চলমান।
মিরপুর সেনপাড়ার একটি নির্মাণাধীন ভবনের জমির অংশীদার আইনুল হকের অভিযোগ, ২০১০ সালে তাদের সঙ্গে ভবন নির্মাণের চুক্তি হয় বিওসিএল-এর। কিন্তু ১১ বছরেও ভবন নির্মাণ শেষ হয়নি। আবাসিক ভবনের অনুমতি নিয়ে ভবনের দোতলায় অবৈধভাবে মার্কেট বানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির এমডি।
জিল্লুর রহমান নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, পল্লবীর পুরোনো থানার বিপরীতে আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি। সেখানে বাবার স্বপ্ন ছিল আমার মায়ের নামে একটি ভবন (জাহানারা ভিলা) নির্মাণ করবেন। বড় স্বপ্ন নিয়ে আমার বাবা সোহলে রানার সঙ্গে চুক্তি করেন। কিন্ত ১১ বছরেও ভবন হয়নি। এরই মধ্যে আমার বাবা মারা গেছেন। ভবন নির্মাণের আগেই সেখানে ফ্ল্যাট দেওয়ার কথা বলে আনেকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সোহেল রানা। এ নিয়ে আদালত এবং থানায় একাধিক মামলা করা হয়েছে।
মিরপুর ডিওএইচএস-এর বাসিন্দা সামছুল আলমের অভিযোগ, মিরপুর ডিওএইচএস-এর ১৩২ নম্বর ভবনটির অনুমোদন আছে ছয়তলার। অথচ সোহেল রানা অবৈধভাবে সাততলা ভবন তৈরি করেছেন। সাততলার ফ্ল্যাটগুলো জমির মালিককে বুঝিয়ে না দিয়ে সেগুলো বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ করেছেন সোহেল রানা।
সোহেল রানার বিরুদ্ধে ভবন নির্মাণে প্রতারণার আরও যারা অভিযোগ করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-মিরপুর ডিওএইচএস ৬ নম্বর অ্যাভিনিউয়ের আতিকুজ্জামান (অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার ছেলে), ধোলাই খালপাড় মাকের্টের আব্দুল মালেক এবং নরসিংদী পার্ক টাউনের বেশ কয়েকজন ব্যক্তি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শনিবার সন্ধ্যায় রিহ্যাব সহসভাপতি ও বিওসিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী সোহেল রানা যুগান্তরকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এসেছিল সেগুলোর বিষয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। এরই মধ্যে বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।